প্রাথমিক শিক্ষায় সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে যে কয়েকটি দেশ বিশ্বে শীর্ষে অবস্থান করছেন, দক্ষিণ কোরিয়া তাদের মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছেন।আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা সারা পৃথিবীর প্রাথমিক শিক্ষার চিত্র নিয়ে গবেষণা,সমীক্ষা চালিয়ে প্রতি বছর প্রতিবদন প্রকাশ করে থাকেন।
এতে শিশু ভর্তি, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী হার, ঝরে পড়ার হার এবং সর্বোপরি মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা সূচক ইত্যাদি যাচাই করা হয়। সকল ধরণের সূচকে ফিনল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়া প্রাথমিক শিক্ষায় অভাবনীয় সাফল্য অর্জন অব্যাহত রেখেছেন।
এমন কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারতের চেয়েও তাদের সাফল্যের হার অনেক বেশি। চীন এবং জাপানও তালিকার ১ম দিকে অবস্থান করছেন। আজকের প্রতিবেদনে প্রাথমিক শিক্ষায় দক্ষিণ কোরিয়ার সাফল্য তুলে ধরা হল।
প্রাক-শৈশবকালিন শিক্ষাস্তর-
দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রাক-শৈশবকাল হতে শিশুদের মৌলিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। শুধু জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় এই স্তরকে গুরুত্ব দেয়া হয় না, বরং স্বাস্থ্যবান ও বুদ্ধিমান শিশু হিসেবে গড়ে তোলা,দরিদ্র শিশুদের কল্যাণ সাধন এবং কর্মজীবী নারীদের শিশুদের কথাও এতে বিবেচনা করা হয়।
নার্সারী স্তরে প্রাক-শৈশবে শিশুদের শিখণ-শেখানো চলে। এই স্তরে এসব শিশুর শিখনের কল্যাণমূলক নীতির প্রতিফলন ঘটানো হয়। ১৯৫২ সালে নার্সারী শিক্ষা ব্যবস্থার ১ম প্রচলন ঘটে এবং ১৯৬২ সালে শিশু কল্যাণ আইনের মাধ্যমে তা বাধ্যতামূলক করা হয়। ১৯৮০-এর দশকে কল্যাণ রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য দক্ষিণ কোরিয়া শিশু বা প্রাক-শৈশবকালীন শিক্ষার বিকাশে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহন করেন। এ আইনের আওতায় গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্র নার্সারী শিক্ষার প্রসার ঘটে।
এভাবে তাদের সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নার্সারী বা প্রাক-শৈশবকালীন শিশুদের পড়াশোনার ব্যাপক সুযোগ সৃস্টি হয়। এই কিন্ডারগার্টেন বা নার্সারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি ভর্তুকী দেয়া হয় না, বেসরকারিভাবেই তা পরিচালনা করা হয়।
বিদ্যালয়ে শিশুদের আনুষ্ঠানিকভাবে ভর্তি হওয়ার পূর্বে চলা প্রি-স্কুল শিক্ষা স্তরটি একটি নতুন প্রবণতা যা ধর্মীয়ভাবে, সামাজিকভাবে এবং বেসরকারিভাবে পরিচালনা করা হয়। আর সরকার, এ স্তরকে উৎসাহিত করতে বিভিন্নভাবে সহায়তা দিয়ে থাকে। বর্তমানে ১০০ ভাগ শিশু, যারা ৫ বছরের মধ্যে তারা এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ে থাকেন।
প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা-
১৯৪৫ সাল হতে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। আর ১৯৭৯ সাল হতে প্রাথমিক শিক্ষা বিনা বেতনে পরিচালিত হয়ে আসছে। ৬ বছর বয়সে সাধারণত সে দেশের শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে ভর্তি হন এবং প্রতি বছর পরবর্তী শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়। মেধাবী ও প্রতিভাবান শিশুদেরকে কখনও কখনও ডাবল প্রমোশনও দেয়া হয়।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রাথমিক শিক্ষাক্রমে ৯ টি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয় , সেগুলো হলো: কোরীয় ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান, শারিরীক শিক্ষা, সমাজ বিজ্ঞান, নৈতিক শিক্ষা, চারু ও কারু কলা। শিক্ষার আন্তর্জাতিকীকরণকেও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়।ইংরেজি বিষয়টি তৃতীয় শ্রেণি হতে পড়ানো হয়।
১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে দ্রুত শিল্পায়ন প্রক্রিয়ায় শহর এলাকায় বিদ্যালয় গমনোপযোগি শিশুদের ওপর বেশ জোর দেয়া হয় কিন্তু শ্রমিক এলাকায় তা হ্রাস পায়। শহুরে বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তির চাপ অত্যধিক বেশি হওয়ায়, ডাবল শিফট চালু করা হয়।
কোরিয়ান সরকার ১৯৮২ সালে জনগণের উপর শিক্ষা কর আরোপ করেন । এই করের মাধ্যমে শিক্ষা খাতে ব্যয় এবং শিক্ষকদের বেতন-ভাতা অধিক পরিমাণে বৃদ্ধি করা হয়।
এতে দক্ষিণ কোরিয়ায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যকার অনুপাত হয় ১ঃ২৮ জন। ১৯৬০-এর দশকেই তাদের বিদ্যালয় গমনোপযোগি ১০০ ভাগ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, ১৯৪৫ সালে স্বাধীনতা লাভের সময় দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল, ২,৮০৭ টি। আর শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১,৫৭,০০০ জন।
১৯৯৯ সালে, প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং অনুরূপ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৫৪৪ টি সরকারি ও বেসরকারি ৭৩৯ টি। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩৯,৩৫০০০ জন। এভাবে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিদ্যালয়ের সংখ্যা ও শিশু ভর্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনকারি ১০০% শিক্ষার্থীই মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে ভর্তি হয়ে থাকেন।
উপরে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রাথমিক শিক্ষা সাফল্য নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তাদের সাফল্যের কারণ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, মূলত প্রাক-শৈশবকাল হতে শিশুদের শিখনে আগ্রহী করে তোলা এবং শিক্ষা ও শিক্ষকদের পিছনে অধিক ব্যয় করার কারণে তারা সফল হয়েছেন। বাংলাদেশও তাদের পথ অনুসরণ করতে পারেন।
লেখক-মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ,সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার।
আরো পড়ুন
বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবীদের প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া উচিত-অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক
২০ অক্টোবরের মধ্যে প্রাথমিকে সার্কুলার প্রকাশের সিদ্ধান্ত,আবেদন ফি ১৭০ টাকা
ইএফটির মাধ্যমে সরাসরি অ্যাকাউন্টে বেতন-ভাতা পাবেন প্রাথমিকের শিক্ষকরা