প্যানেলের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের দাবীর কোন যৌক্তিকতা আছে কি?

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে প্যানেলের মাধ্যমে প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক নিয়োগের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন। আবার কিছু প্যানেল প্রত্যাশী কাফনের কাপড় পরিধান করে প্যানেলের দাবী জানাচ্ছেন।

শিক্ষকতার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ না দিয়ে ঢালাওভাবে হঠাৎ করে প্যানেলের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দিলে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করা কখনো সম্ভব হবে কী? প্যানেলের পক্ষে যুক্তি কতটুকু আর বিপক্ষে যুক্তি কতটুকু  আলোচনা করলে নীতিনির্ধারকরা সহজেই বুঝতে পারবেন।

প্যানেল দাবীকারীদের যুক্তি হচ্ছে তারা ২০১৪ সাল থেকে সার্কুলার পাননি তাই তাদের বয়স শেষ হয়ে গেছে, তাই তাদেরকে প্যানেলের মাধ্যমে নিয়োগ দিতে হবে। আসলে কি এটা সত্যি? এটা সত্য যে একটা মামলার কারণে সরকার ২০১৪ সাল থেকে সরাসরি সহকারী শিক্ষকের সার্কুলার দিয়ে নিয়োগ দিতে পারেনি কিন্তু বিকল্পভাবে সরকার পিইডিপি-৩ এর আওতায় ২০১৪, ২০১৬ এবং ২০১৭ (মুক্তিযোদ্ধা কোটা) সালে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা মাধ্যমে ৩৬ হাজারের মত সহকারী শিক্ষক (প্রাক-প্রাথমিক) নিয়োগ প্রদান করেছেন।

তাই সার্কুলার না পাওয়ার কথা পুরোপুরি অযৌক্তিক।আর চাকরি কি শুধু প্রাথমিক শিক্ষক পদে রয়েছে, অন্য ডিপার্টমেন্টগুলোতেও কি সার্কুলার বন্ধ ছিল? অনেক চাকরি প্রার্থীর আবেদনের বয়স নাই কিন্তু তাই বলে কি প্রাথমিক শিক্ষকের মত গুরুত্বপূর্ণ পদে  অনূত্তীর্ণ সবাইকে  দয়া করে নিয়োগ দিতে হবে?আন্দোলনের কারণে চাকরি দিতে হলেতো সকল বেকারদের চাকরি দিতে হবে।

প্যানেলের মাধ্যমে নিয়োগ দিতে হলে সার্কুলারে প্যানেলের কথা উল্লেখ থাকতে হবে।যেমন ব্যাংকে উল্লেখ থাকে।সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিয়োগের ইতিহাসে কখনো প্যানেলের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হয়নি।

প্যানেল আবেদনকারীরা যুক্তি দেখাচ্ছেন তারা ২৪ লক্ষ পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ৫৫ হাজার লিখিত পরীক্ষায় পাস করেছেন, তাই তাদেরদকে প্যানেলের মাধ্যমে নিয়োগ দিতে হবে। প্রাথমিক নিয়োগের ইতিহাসে কি শুধু প্যানেল আবেদনকারীরা লিখিত পরীক্ষায় পাস করেছেন, ইতিপূর্বের নিয়োগগুলোতে যারা ভাইভা দিয়েছিলেন কিন্তু চাকরি পাননি, উনারা কি তাহলে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হননি? শুধু লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করে বাংলাদেশের কোন ডিপার্টমেন্ট চাকরি দেবে?

তাছাড়া নিয়োগ দেয়ার কথা ছিল যেখানে ১২ হাজার কিন্তু সেখানে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ১৮ হাজার। তাহলে এখানে প্যানেলের মাধ্যমে নিয়োগের প্রশ্ন আসে কেন? শূন্য পদ আছে। তাহলেতো একটা করে সার্কুলার দিয়ে প্যানেলের মাধ্যমে ঐ ডিপার্টমেন্টগুলোতে একবারেই নিয়োগ দিতে পারে। কিন্ত দেয়না কেন? আর লিখিত পরীক্ষায় অনেকে সর্বনিম্ন নম্বর পেয়ে এবং অনেকে সর্বাধিক নম্বর পেয়ে ভাইভায় অংশ নেয়। লিখিত পরীক্ষায় যারা নম্বর বেশী পায় তারাই বেশীরভাগ ভাইভায় উত্তীর্ণ হয়ে নিয়োগ পান।

লিখিত পরীক্ষায় একজন ৭০এর উপরে নম্বর পেয়ে ভাইভা দিয়েছেন, আরেকজন লিখিত পরীক্ষায় কোনরকমে ৫৫পেয়েও ভাইভা দিয়েছেন,তাহলে দুজনের যোগ্যতা কি সমান হল? যারা মেধাবী তারা পরবর্তী সার্কুলার হলে অবশ্যই নিয়োগ পাবেন এবং জাতিও তাদেরকে স্বাগত জানাবেন। প্যানেল দাবীকারীরা যুক্তি দেখাচ্ছেন পূর্বে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে প্যানেল ছিল তাহলে এখন নয় কেন?

তাদের এই যুক্তিও অযৌক্তিক। পূর্বে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিয়োগের জন্য সরকার ভাইভায় একটা সংখ্যক নিয়োগ দিয়ে বাকিদের প্যানেল করে রেখেছিল কারণ বেসরকারী প্রাথমিকে মেধাবীরা কখনোই চাকরি করতোনা,অনেকে যোগদান করলেও কয়েকদিন পরে ছেড়ে দিত।

তাই সরকার নির্ধারিত সেই প্যানেলের মাধ্যমে আগে বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দিত। পরবর্তীতে সেই বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সরকার জাতীয়করণ করলে তখন সরকার আগের সেই বেসরকারী প্যানেল থেকে নিয়োগ দেয়া বন্ধ করে দেয়। কারণ, জাতীয়করণের ফলে পূর্বের বেসরকারী প্রাথমিক শিক্ষকরা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের মর্যাদা পান।

এতে পূর্বের বেসরকারী প্যানেলের  তালিকায় থাকা ব্যক্তিরা সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করলে হাইকোর্ট তাদের পক্ষে রায় দেন এবং সরকারও হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না করে তাদের নিয়োগ দিতে সম্মত হন। তাই সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে আগে কখনোই প্যানেল করা হয়নি।

প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগবিধিতে কোন প্যানেলের অস্তিত্ব নেই তাই সরকার এখন হঠাৎ করে প্যানেল করলে পূর্বের নিয়োগগুলোতে যারা ভাইভা দিয়েও প্রাথমিক শিক্ষক হতে পারেননি তারাও আন্দোলন ও রিট করবেন যা বিশৃংখলা সৃষ্টি করবে। এছাড়া সার্কুলার না পেয়ে ফ্রেশ গ্রাজুয়েটরাও ক্ষুদ্ধ হবেন।

তাই কর্তৃপক্ষের কাছে বিশেষ অনুরোধ  দ্রুত সার্কুলার প্রকাশ করে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাবীদের প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশায় নিয়ে আসুন।

লেখক-মাহফিজুর রহমান মামুন, শিক্ষক। (মতামতের জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন)

আরো পড়ুন
এবার ঘরে বসেই অনলাইনে পেনশন ও জিপিএফের তথ্য দেখতে পারবেন
মানসম্মত বেতন-মর্যাদা না পেলে মেধাবীরা প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশায় আসবেন কেন?
সমালোচনার জবাব-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বনাম কিন্ডারগার্টেন

Check Also

প্রাথমিক শিক্ষক

সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড দিয়ে পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হোক

দেশের নীতিনির্ধারকগণ বলেন প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছেন শিক্ষার ভিত্তি, ভিত্তি মজবুত না হলে শিক্ষার উন্নয়ন কখনোই …

প্রাথমিক শিক্ষক

১০ম গ্রেড দিয়ে সহকারী শিক্ষকদের আর্থ-সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা হোক

প্রাথমিক শিক্ষকরা অবুঝ শিশুদের শিক্ষা দেয়ার মত সবচেয়ে কঠিন ও গুরুদায়িত্ব পালন পালন করেন।পরিশ্রমের দিক …

আপনার মতামত জানান