প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশাটাকে দেশ থেকে একেবারে বিলুপ্ত করা হোক

একজন শিক্ষক নাকি মানুষ গড়ার কারিগর,আলোকিত মানুষসহ আরো কত কি উপাধী দেয়া হয়।ছোটবেলা থেকে শিশুদের আমি খুব ভালোবাসি তাই তাদের সঙ্গ আমার ভালোই লাগে।তাইতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেও স্বেচ্ছায় কোনরকম কোটা ছাড়াই প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করি।

প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশায় যোগদানের পর ইচ্ছে করেই অন্য পেশায় যাওয়া হয়নি।কারণ দুটো (১) বাড়িতে বাবা মাসহ পরিবারের সাথে নিজের বাড়িতে থাকতে পারা,(২)শিশুদের সংস্পর্শে থাকা।আর্থিকভাবে আমি স্বচ্ছল বলে প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে স্বল্প বেতন পাওয়ার দুঃখটাও ভুলে থাকি।

তাছাড়া অন্য শিক্ষকদের মতোও আমি নই।আমি আমার পোশাকে,আচরণে,কথায় যথেষ্ট স্মার্ট।কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষকদের শুধু বেতন স্বল্পতার বিষয়টি নয়,প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশাটি যে আমাদের দেশে এত জঘন্যমানের তা কখনোই আমি বুঝতে পারিনি যা বুঝতে পারলাম গতকাল থেকে।

তখন থেকে আমার মন খুব খারাপ,নিজের কাছে নিজেকে লজ্জা লাগতেছে।আমার কাছে মনে হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষক হওয়ার চেয়ে কোন অফিসের কেরাণী/পিয়ন হওয়াও(শিক্ষকদের মর্যাদা বুঝাতে আমি উল্লেখিত সম্মানিত ভাইদের প্রতি সম্মান রেখে জাস্ট উদাহরণ দিলাম,অপরাধ হলে ক্ষমা করবেন) অনেক অনেক বেশী সম্মানের।

যাহোক বাংলাদেশের যেকোন একটি জেলার সদর ইউএনও অফিসে আমার ওয়াইফ জব করেন।গতকালকে ঐ ইউএনও মহোদয়ের মেয়ের জন্মদিন ছিল,সেই জন্মদিনে আমার ওয়াইফের সাথে আমাকেও ইনভাইট করা হয়েছিল।সেই ইনভাইটে অংশগ্রহণ করে খাওয়ার সময় হঠাৎ ইউএনও স্যার আমাকে বললেন,আচ্ছা বলুনতো কতবছর পরে প্রাইমারী টিচারদের কোর্টে স্বাক্ষী হিসেবে নেয়া হয়না?

আমি খেতে খেতে ভদ্রতার সাথে বললাম জানিনা স্যার এবং ওটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন কথা।তারপরও স্যার বারবার জোর করে বলতেছেন এটা সত্য কথা।আমার পাশে বসা অন্য উপজেলার একজন স্টোনোগ্রাফার বলতেছেন ঠিক বলেছেন স্যার।আমার আরেক পাশে বসা উপজেলার সহকারী প্রোগ্রামার স্যার বলতেছেন,প্রাইমারী টিচারদের বাচ্চা পড়াতে পড়াতে মাথা শেষ।

উনার কথার পরে ইউএনও স্যার আবার বলা শুরু করলেন,প্রাইমারি টিচাররা বাচ্চা পড়াতে পড়াতে ঝিমায় যায়।আমি স্কাউট নিয়ে কাজ করতেছি,দেখতেছি তাদের মধ্যে কোন চঞ্চলতা নেই,শিশুদের পড়াতে পড়াতে ওদের মাথা শেষ।বাচ্চারা গোলমাল করে শিক্ষকদের মাথা নষ্ট করে দেয়।

ঐসময় সম্নানিত উপজেলার চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য অফিসারগণ একসাথে বসে খাচ্ছিলাম।আমি তখন লজ্জায় কুকড়ে গেছি,মনে হচ্ছিল আল্লাহ যেন মাটিটা ভাগ করে দেন আর আমি সেখানে ঢুকে নিজের লজ্জা নিবারণ করি।আমি গতকালকে বাসায় আসার পরে কোথাও শান্তি পাচ্ছিনা,খুব মন খারাপ।

আমার ওয়াইফ আমাকে শান্ত্বনা দিয়ে বলতেছে মন খারাপ করোনা,আমরা সুখি পরিবার এটাই বড় কথা।কিন্তু আমার মনে হচ্ছে একটু কান্না করতে পারলে আমি শান্তি পাই। আমার নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে যে কেন আমি প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করে কোমলমতি শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য সচেষ্ট হলাম?

যারা প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশাটাকে অপমান করলেন তারা সবাই একসময় সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষকের শিক্ষার্থী ছিলেন।অথচ আজ তারাই নিজেদের শিকড়কে ভুলে সেই শিক্ষাগুরুদেরকেই অপমান করতেছেন।মনে হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ,ফাঁকিবাজ কর্মচারী হচ্ছেন প্রাথমিক শিক্ষকগণ,তারাই সুইস ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাচার করছেন,দেশে গাড়ীবাড়ীর মালিক হচ্ছেন,বাকি সবাই ধেয়া তুলসীপাতা।

তাইতো যে যেভাবে পারছেন প্রাথমিক শিক্ষকদের অপমান করছেন।একদিকে প্রাথমিক শিক্ষকদের সমযোগ্যতায় নিয়োগপ্রাপ্ত অন্য বিভাগের কর্মচারীদের চেয়ে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন-পদমর্যাদা,ছুটিসহ সকল বিষয়ে বঞ্চিত করে ছোট করে রাখা হচ্ছে।

আরেকদিকে ছোট শিশুদের পড়াই বলে শিক্ষকদের পাগলের খেতাব দেয়া হচ্ছে।দিনে দিনে প্রাথমিক শিক্ষকদের উপর অহেতুক কাজের চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে।অথচ প্রাথমিক শিক্ষকদের কাছে না পড়ে আজ কেউ নিজেদের অবস্থানে যেতে পারেননি,তারপরও প্রাথমিক শিক্ষকদের আর্থসামাজিক সবক্ষেত্রে চরমভাবে অবহেলা ও অপমান করা হচ্ছে।

এই হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষকদের মর্যাদা।তাই প্রাথমিক শিক্ষকদের এভাবে তিলে তিলে অপমান না করে কর্মরত শিক্ষকদের গুলি করে অথবা ফাঁসি দিয়ে মেরে ফেলুন এবং প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশাটাকে দেশ থেকে একেবারে বিলুপ্ত করা হোক।

লেখকঃ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রাথমিক শিক্ষক

আরো পড়ুন
কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষার্থীদের আপাতত বই না দিতে লিখিত নির্দেশ
২৬ থেকে ২৮ ডিসেম্বরের মধ্যে এসএসসি ও সমমানের ফল প্রকাশের প্রস্তাব
জেএসসি পরীক্ষার শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ফরম পূরণের সময় বাড়লো
সমালোচনার জবাব-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বনাম কিন্ডারগার্টেন

Check Also

প্রাথমিক শিক্ষক

সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড দিয়ে পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হোক

দেশের নীতিনির্ধারকগণ বলেন প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছেন শিক্ষার ভিত্তি, ভিত্তি মজবুত না হলে শিক্ষার উন্নয়ন কখনোই …

প্রাথমিক শিক্ষক

১০ম গ্রেড দিয়ে সহকারী শিক্ষকদের আর্থ-সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা হোক

প্রাথমিক শিক্ষকরা অবুঝ শিশুদের শিক্ষা দেয়ার মত সবচেয়ে কঠিন ও গুরুদায়িত্ব পালন পালন করেন।পরিশ্রমের দিক …

আপনার মতামত জানান