প্রাথমিক শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড না দেয়া মানেই শিক্ষার্থীদের মেধাবী শিক্ষক থেকে বঞ্চিত করা

সিংগাপুরে একটি প্রবাদ আছে যদি অর্থনীতিতে উদীয়মান বাঘ্র হতে চাও তবে প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ কর।সিংগাপুর এই প্রবাদ অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালন করেছে বলে বাস্তবে সিংগাপুর আজ অর্থনীতিতে উদীয়মান বাঘ।আমাদের দেশের জনগণ না জানলেও আমাদের নীতিনির্ধারক মহোদয়গণ ঠিকই জানেন যে সিংগাপুর সরকার প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের পিছনে সবচেয়ে বেশী বিনিয়োগ করেন ।

এমনকি আপনি জানলে অবাক হবেন “সিংগাপুর সরকার তাদের দেশে সবচেয়ে বেশী মেধাবীদের উচ্চ বেতন পদমর্যাদা দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত করেন।তাইতো সিংগাপুর আজ এত উন্নত।

আমাদের দেশের সাথে প্রায় একই সময়ে স্বাধীন হওয়া আরেকটি দেশের নাম হচ্ছে মালয়েশিয়া। মালয়েশিয়ার ৭০০ শিক্ষার্থী সমৃদ্ধ একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংখ্যা ৯৫জন।প্রতি শিক্ষকের জন্য আলাদা আলাদা ব্যক্তিগত রুম বরাদ্দ রয়েছে,সকল শিক্ষকের ব্যক্তিগত গাড়ি রয়েছে।

মালয়েশিয়ায় প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন ও পদমর্যাদা অতি উন্নত।তাদের প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লাইব্রেরী,রিডিং রুম রয়েছে।প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের পিছনে বিনিয়োগ করার কারণেই সিংগাপুর ও মালয়েশিয়ার সাথে প্রায় একই সময়ে আমাদের দেশ স্বাধীন হলেও আজ তাদের অবস্থান কোথায়,আর আমাদের অবস্থান কোথায়?

প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের পিছনে ব্যয় করতে আমরা যতটা কৃপণতা করি,বিপরীতে বালিশ,পর্দা কিনতে কিন্তু আমরা অনেক অনেক উদারতা প্রকাশ করি।আমাদের দেশের অনেকে প্রাথমিক শিক্ষকদের মর্যাদা বাড়ানোর কথা বললে কটাক্ষ করতে আসেন কিন্তু তারা এটা বুঝতে পারেন না যে দেশকে উন্নতি শিখরে আরোহরণ করাতে হলে অবশ্যই এবং অবশ্যই প্রাথমিক শিক্ষকদের উচ্চ বেতন মর্যাদা দিয়ে মেধাবীদের এ পেশায় আকৃষ্ট করতে হবে।

এখন আমরা যদি আমাদের দেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যেতে না চাই সেটা আলাদা ব্যাপার।কিন্তু দেশকে উন্নত করতে হলে আমাদের দেশের মেধাবীদের উচ্চ বেতন-মর্যাদা দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতেই হবে।অথচ আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষকদের যে বেতন মর্যাদা দেয়া হচ্ছে তাতে মেধাবীরা এ পেশায় আকৃষ্ট হচ্ছেন না।

আবার কর্মরত মেধাবী প্রাথমিক শিক্ষকরাও এ পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।যেসব মেধাবী শিক্ষকরা এখনও কর্মরত রয়েছেন তারাও মর্যাদাহীনতার কারণে ইচ্ছা থাকা সত্বেও নিজেদের এ পেশায় সম্পূর্ণ বিলিয়ে দিতে আগ্রহ হারাচ্ছেন।তাহলে কোন শ্রেণির শিক্ষক দিয়ে আমরা কোমলমতী প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে চাচ্ছি?

দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে নিম্ন বেতন মর্যাদা ভোগ করছেন আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষকরা,অথচ অর্থনীতিতে আমরা ভারত,পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছি।কিন্তু বিশ্বে শিক্ষায় ভারত ও পাকিস্তান আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে কারণ একটাই আমরা না বুঝলেও ভারত ও পাকিস্তান ঠিকই বুঝতে পেরেছে যে প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের মান উন্নত না করলে তাদের দেশের মান কখনোই উন্নত হবেনা।

তাই ভারত ও পাকিস্তান এখন তাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের পিছনে প্রচুর ব্যয় করে মেধাবীদের প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করছেন।ভারতে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে মেধাবীরা প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশায় আসেন অথচ আমাদের দেশে তার পুরোটা উল্টা হয়।

বাংলাদেশে প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হতে হলে একজন ব্যক্তিকে সর্বনিম্ন ২য় শ্রেণির স্নাতক পাশ করে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হতে হয়।নিয়োগ পাওয়ার পরে সেই ব্যক্তিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য আইইর ডিপার্টমেন্টের অধীনে দেড় বছর ধরে কঠোর শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম করে ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারী এডুকেশন কোর্স সম্পন্ন করতে হয়।

তারপরও আমাদের দেশের প্রাথমিকের একজন সহকারী শিক্ষক ১৩তম গ্রেডে বেতন পান অথচ শিক্ষকের সমযোগ্যতায় অথবা নিম্ন যোগ্যতায় নিয়োগপ্রাপ্ত অন্য ডিপার্টমেন্টের সম্মানিত পেশাজীবি ভাইয়েরা ১০ম গ্রেডে বেতন পাচ্ছেন?তাহলে আমাদের দেশে কোথায় প্রাথমিক শিক্ষকের প্রতি মূল্যায়ন করা হচ্ছে?

অন্য পেশাজীবীরা ১০ম গ্রেড পেলেতো সমযোগ্যতায় অথবা উচ্চ যোগ্যতায় নিয়োগপ্রাপ্ত মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে উপাধিপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষকরা আরো আগে ১০ম গ্রেড পাওয়ার কথা ছিল।তাহলে কোন বিবেকে প্রাথমিক শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে?

প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড থেকে বঞ্চিত করার অর্থই হচ্ছে কোমলমতী প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের মেধাবী শিক্ষক থেকে বঞ্চিত করা।আমরা আশা করি ,আমাদের দেশের নীতিনির্ধারক মহোদয়গণ দেশ ও জাতির স্বার্থে প্রাথমিক শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড প্রদান করে কোমলমতী প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের মেধাবী শিক্ষকদের দ্বারা মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করাবেন।

প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড প্রদান করা হলে আমাদের দেশের মেধাবীরাও প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট হবেন।ফলে উন্নত হবে দেশ ও জাতি।এভাবে আমরাও একদিন মালয়েশিয়া ও সিংগাপুরের মত উন্নত দেশে পরিণত হতে সক্ষম হবো।

লেখক-মাহফিজুর রহমান,শিক্ষক ও ব্লগার

আরো পড়ুন
৬ষ্ঠ-৯ম শ্রেণি ও এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণেচ্ছু শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট চালুর আদেশ
২০২০ সালের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ পরীক্ষার ফরম পূরণের সংশোধিত বিজ্ঞপ্তি
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষায় প্রাথমিক ফল প্রকাশ
যেসব পরিবার টিকা নিয়েছেন,কেবল তাদের সন্তানরাই স্কুলে ফিরতে পারবেন

Check Also

প্রাথমিক শিক্ষক

সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড দিয়ে পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হোক

দেশের নীতিনির্ধারকগণ বলেন প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছেন শিক্ষার ভিত্তি, ভিত্তি মজবুত না হলে শিক্ষার উন্নয়ন কখনোই …

প্রাথমিক শিক্ষক

১০ম গ্রেড দিয়ে সহকারী শিক্ষকদের আর্থ-সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা হোক

প্রাথমিক শিক্ষকরা অবুঝ শিশুদের শিক্ষা দেয়ার মত সবচেয়ে কঠিন ও গুরুদায়িত্ব পালন পালন করেন।পরিশ্রমের দিক …

আপনার মতামত জানান