প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের নিয়ে এত হইচই করা হয় কেন?

বাংলাদেশের অল্পকিছু সংখ্যক মানুষ বাদে অধিকাংশ মানুষই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শিক্ষার্থী ছিলেন অথচ এই প্রাথমিক শিক্ষকদের নিয়ে আমাদের অনেকের এত এলার্জি কেন আমি সেটাই বুঝতে পারছিনা?

জাতি হিসেবে আমরা এত অধম যে ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়।এই যে করোনার প্রকোপের কারণে সরকার গত ১৭মার্চ থেকে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছেন।তখন থেকে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রাথমিক বিদ্যালয়,উচ্চবিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়,মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে।স্বভাবতই প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বাসায় সময় কাটাচ্ছেন।

প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে।প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পরেও প্রাথমিক শিক্ষকরা সরকার নির্দেশিত বিভিন্ন কাজগুলো যেমন অনলাইন ক্লাস,শিশুদের ফোনে খোঁজখবর,বিদ্যালয়ের উন্নয়নমূলক কাজগুলো কন্টিনিউ করে যাচ্ছেন।

অথচ সামাজিক মাধ্যমগুলোতে কিছু নাদান পাবলিকের প্রাথমিক শিক্ষকদের নিয়ে সমালোচনা দেখলে মনে হচ্ছে বাংলাদেশে একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো বন্ধ রয়েছে এবং একমাত্র প্রাথমিক শিক্ষকরা স্কুল বন্ধ রেখে বাসায় বসে বসে সময় কাটাচ্ছেন।হাইস্কুল,কলেজ ও ইউনিভার্সিটি খোলা এবং সেই শিক্ষকরা মনে হয় কোন ছুটি কাটাচ্ছেন না।

আপনাদের যদি প্রাথমিক শিক্ষকদের ছুটি দেখে এত হিংসা হয় তাহলে আপনারাও প্রাথমিক শিক্ষক হয়ে যান বা হওয়ার চেষ্টা করুন।যেখানে করোনার প্রকোপের কারণে সারা বিশ্ব কাঁপতেছে এবং আমাদের দেশের নীতিনির্ধারক মহোদয়গণ এইচএসসি পরীক্ষার মত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা নিতে দশবার ভাবতেছেন,সেখানে এই অতি জ্ঞানী কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়,হাইস্কুল,কলেজ খোলার কথা না বলে প্রাইমারী নিয়ে পড়ে আছেন।

অবশ্য তাদের প্রাইমারী নিয়ে পড়ে থাকার একটাই কারণ প্রাইমারী শিক্ষকরা বসে কেন বেতন নিবে এটা তাদের সহ্য হচ্ছেনা।

শিক্ষকের সামান্য বেতনের চেয়ে যে অভিভাবকদের কাছে তাদের সন্তানরা অনেক বড় এটা এইসব পাবলিক বুঝেও না বুঝার ভান করে।কারো সন্তান মারা গেলে সেটা আপনাদের কাছে মনে হবে একটা সংখ্যামাত্র কিন্তু যার সন্তান আছে তার কাছে গোটা পৃথিবীর চেয়েও বড় সন্তান।সন্তান বেঁচে থাকলে পড়াশুনা করতে পারবে কিন্তু সেই সন্তান বেঁচে না থাকলে পড়াশুনা দিয়ে কি হবে?

স্কুল খোলা থাকলে এরাই আবার বলে প্রাথমিক শিক্ষকরা স্কুলে পড়ায়না,বসে বসে ঘুমিয়ে বেতন নেয়।উনাদের মতে স্কুলে যেহেতু পড়াশুনা হয়না তাহলে স্কুল খোলা নিয়ে অহেতুক আগ্রহী কেন এইসব হিংসুক সমালোচকদের?

স্কুল বন্ধ থাকায় প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা এখন বুঝতে পারছেন যে সন্তানদের পড়াশুনায় শিক্ষকরা কতটা প্রয়োজনীয়।শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ না থাকায় সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এইচএসসি পরীক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।তারপরও এইচএসসি পরীক্ষা নিতে ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে যেখানে করোনার আশংকা করা হচ্ছে সেখানে কিছু সংখ্যক মানুষ কেন পড়ে আছে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা নিয়ে?

আমাদের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে করোনায় আক্রান্তের হার খুবই কম,তারপরও তারা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে বাদ রেখে বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিয়েছে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে যারা পড়াশুনা করেন তারা সবাই শিশু,যারা অবুজ,ভালো-মন্দ,রোগের সংক্রমণ বোঝার মত বয়স এখনো তাদের হয়নি।তাই বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে ধারাবাহিকভাবে প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়,তারপর কলেজ,তারপরে হাইস্কুল এবং সবার শেষে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলার দরকার।

আবার কিছু পাবলিক বলতেছেন বাজার,অফিস,পরিবহন সবইতো চলতেছে,প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো খুললে কি সমস্যা? বাজার,পরিবহন সবই সরকার চালু রেখেছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিচালনা করার জন্য কিন্তু আমরাতো সেভাবে কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানছিনা।

তাহলে সরকারের দোষ দিয়ে লাভ কি? নিজেরা স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সরকারের পক্ষে কি সম্ভব সবাইকে জোর করে স্বাস্থ্যবিধি পালন করানোর?

স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে দেশে করোনায় আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তেই আছে।কথায় আছে যার জ্বালা সেই বুঝে।যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বেদনা কি?বড়রা যেখানে স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না সেখানে প্রাথমিকের কোমলমতী শিশুরা বিদ্যালয়ে স্বাস্থবিধি মানবে এটা আকাশ-কুসুম চিন্তা ছাড়া কিছুই নয়।

এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো বন্ধ বলেই শিশুদের আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলক কম।কিন্তু স্কুল খুললে একজন অবুঝ ও কোমলমতী শিক্ষার্থী যদি করোনায় আক্রান্ত হয় তাহলে নিমিষেই গোটা স্কুল আক্রান্ত হবেন,আর গোটা স্কুল আক্রান্ত হলে তার যে ভয়াবহ পরিণতি হবে তা কল্পনাও করা যায়না।

প্রাথমিক শিক্ষা পরিবার অনেক বড় হওয়ায় মিডিয়া নিজেদের ভিউয়ার বাড়ানোর জন্য ছোট ছোট বিষয়গুলো নিয়েও নিউজ করে।অথচ হাইস্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও তাদেের নিয়ে কোন নিউজ হয়না।

এই প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন নিয়েই দেখুন না,আজ পর্যন্ত কোন প্রাথমিক শিক্ষকের ১টাকা বেতনও বাড়তি হয়নি অথচ এই মিডিয়াগুলো প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর সুখবর নিয়ে এত বেশী নিউজ করেছে যে পাবলিক মনে করেছে আহারে প্রাথমিক শিক্ষকদের সরকার এত এত দিচ্ছে তারপরও এদের খালি চাই আর চাই।অথচ বাস্তবে প্রাথমিক শিক্ষকরা একটা কানাকড়িও এখনোও বাড়তি পায়নি।

তাই আমাদের উচিত যেসব মিডিয়া প্রাথমিক শিক্ষকদের নিয়ে ঘন্টায় ঘন্টায় এসব ফালতু নিউজ করেন তাদের নিউজ অতিউৎসাহী হয়ে প্রচারের জন্য শেয়ার না করা।

তাদের এইসব নিউজ আমরা যত শেয়ার করছি,প্রাথমিক শিক্ষকদের বিষয়ে হিংসা পোষণ করা পাবলিকদের আমাদের কটাক্ষ করতে তত সুবিধা হচ্ছে,অন্যদিকে মিডিয়ার পাঠক সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তারাও প্রাথমিক শিক্ষকদের নিয়ে এইসব ফালতু নিউজ করতেও আগ্রহী হচ্ছেন।নিজেদের মর্যাদা রক্ষার্থে প্রাথমিক শিক্ষকরা আশা করি এ বিষয়ে পুরোপুরি এবার সচেতন হবেন।

লেখক-মাসুম,শিক্ষক।

আরো পড়ুন
ইউএনও অফিসের দারোয়ান-ড্রাইভারও প্রাথমিক শিক্ষকের চেয়ে বেশি বেতন পায়-অধ্যাপক কামরুল হাসান
জেনে নিন ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন কোর্সের খুঁটিনাটি
আপনার শিশুকে যেভাবে পড়াশুনায় আগ্রহী করে তুলবেন

Check Also

প্রাথমিক শিক্ষক

সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড দিয়ে পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হোক

দেশের নীতিনির্ধারকগণ বলেন প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছেন শিক্ষার ভিত্তি, ভিত্তি মজবুত না হলে শিক্ষার উন্নয়ন কখনোই …

প্রাথমিক শিক্ষক

১০ম গ্রেড দিয়ে সহকারী শিক্ষকদের আর্থ-সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা হোক

প্রাথমিক শিক্ষকরা অবুঝ শিশুদের শিক্ষা দেয়ার মত সবচেয়ে কঠিন ও গুরুদায়িত্ব পালন পালন করেন।পরিশ্রমের দিক …

আপনার মতামত জানান