বিশ্বের আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থায়,প্রাথমিক শিক্ষকরা মেধা,বেতন ও মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ আসনে থাকেন

আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশাটি অনেকের কাছে  সাময়িক একটি পেশা হিসেবে পরিণত হয়েছে। নন-ক্যাডারে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তদের অনেকেই পরবর্তীতে চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। আর কেনই বা দিবেন না? এটি দ্বিতীয় শ্রেণির  গেজেটেড সরকারি কর্মকর্তার পদ অথচ  বেতন তার অন্যদের চেয়ে এক গ্রেড নিচে!

মূলত যথাযথ সামাজিক মর্যাদার অভাব এবং পর্যাক্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। বেছে নেন তুলনামূলক অধিক সামাজিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিক সুবিধাসম্পন্ন অন্য কোন পেশাকে অথচ শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড বলে আমরা মুখে ফেনা তুলছি।

এ তো গেল শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের কথা। প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ন্যূনতম দ্বিতীয় শ্রেণির স্নাতক এবং যোগদানের পরে বাধ্যতামূলকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দেড় বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারী এডুকেশন সম্পন্ন করতে হয়।অথচ তাদের পদমর্যাদা এখনো ৩য় শ্রেণির কর্মচারী।কী সেলুকাস!

বাংলাদেশে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকতার সাধারণ একটি  চিত্র দেখা যায়, এদেশে সর্বোচ্চ মেধাবী শিক্ষকরা কাজ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, এরপর ক্রমান্বয়ে কলেজ, মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়। অর্থাৎ স্তরের সাথে একই সমান্তরালে শিক্ষকদের মেধারও ক্রমাবনতি হচ্ছে, সেই সাথে শিক্ষকদের প্রাপ্ত সামাজিক মর্যাদা, বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও নিম্নগামী  করা হচ্ছে।

অথচ আদর্শ  শিক্ষা ব্যবস্থার চিত্র কিন্তু এমন হওয়ার কথা নয়। উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি ফিনল্যান্ডের কথা। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে ফিনল্যান্ডে। সেখানে শিক্ষকতা পেশায় আসেন উচ্চশিক্ষিত সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা এবং শিক্ষক হওয়ার আগেই তাদেরকে একটি কোর্সও করতে হয়। সেই কোর্সে যারা সবচেয়ে ভালো করেন, তারা সুযোগ পান প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে, তারপর মাধ্যমিকে, সবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে।  শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতনও একইভাবে নির্ধারণ করা হয়।

শুধু ফিনল্যান্ড নয়, বিশ্বের যেসব দেশে আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে সেখানে প্রাথমিক শিক্ষকরা থাকেন মেধা ও বেতন-পদমর্যাদায় শ্রেষ্ঠ আসনে।সেই সাথে প্রাথমিক শিক্ষকরা হন শ্রেষ্ঠতম মানবিক গুণ ও নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন ব্যক্তি। কেননা শিক্ষা যদি হয় জাতির মেরুদণ্ড, তাহলে সেই মেরুদণ্ডের কারিগর হলেন শিক্ষকেরা, এবং তাদেরকে সেই মেরুদণ্ড গড়ে তোলা ও সোজা রাখার কাজ শুরু করতে হবে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই।

বাবা-মায়ের পর শিক্ষকরাই হয়ে থাকেন কোমলমতি শিক্ষার্থীদের রোল মডেল বা স্বপ্নের নায়ক বা আদর্শ কারণ  এই শিক্ষকদের মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের বাইরের দুনিয়ার সাথে পরিচয় ঘটে ও তাদের মেধার ক্রমবিকাশ ঘটতে থাকে। একটি শিশুর মেধা ও মননের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়ে যায়ও এই বয়সেই।

তাই সেই ভিতটা যেন সবচেয়ে বেশী মজবুত ও শক্তিশালী হন, তা নিশ্চিত করতে প্রাথমিক বিদ্যালয়েই তো সর্বোচ্চ মেধাবী শিক্ষকদের থাকা একান্ত অপরিহার্য।তারপর ক্রমান্বয়ে  শিক্ষকদের অবস্থান হবে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হবেন নির্দিষ্ট  একটি বিষয়ের উপর সর্বোচ্চ জ্ঞানী তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের  শিক্ষকদের মতো উনাদের সব বিষয়ে জ্ঞান থাকাটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।

কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার চিত্র পুরোপুরি ৩৬০ ডিগ্রী উল্টা, তাই এটা সহজেই  বলাই যায় যে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা হাঁটতেছে উল্টা পথে!

উল্টা পথে হাঁটার কারণেই, উন্নত বিশ্বে যেখানে  প্রাথমিক শিক্ষকদের মান, সম্মান ও সম্মানী আকাশচুম্বী, সেখানে আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষকদের সবই নিম্নমুখী করে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি প্রচন্ড অভাবের যন্ত্রণা, সামাজিক মর্যাদাহীনতা ও পেশাগত হীনম্মন্যতার ফলে অনেক শিক্ষক বাধ্য হয়ে হারিয়ে ফেলতেছেন তাদের মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধও। তাই অনেকে শ্রেণিকক্ষের পাঠদানে  গুরুত্ব দেয়ার  বদলে  ঝুঁকছেন প্রাইভেট কিংবা কোচিংয়ের দিকে।

বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়ন করার জন্য প্রাথমিক শিক্ষকদের  বিভিন্ন রকম প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে , কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থার গোড়াতেই যেখানে গলদ থেকে যাচ্ছে, সেদিকে কারো নজর নেই,বলা যায় ইচ্ছে করেই কেউ নজর দিচ্ছেন না। ফলে প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশার অবহেলিত অবস্থার পরিবর্তনের বিন্দুমাত্র আভাসও পাওয়া যাচ্ছে না।

তাই এ বিষয়টির প্রতি আমাদের সকলেরই নজর ফেরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি। জাতিসংঘের বৈশ্বিক উন্নয়ন রূপরেখা-২০৩০ বা টেকসই উন্নয়ন (এসডিজি) চার নম্বরেই রয়েছে মানসম্মত শিক্ষার বিষয়টি  এবং সেখানে স্পষ্টভাবে বলেই দেয়া হয়েছে যে মানসম্মত শিক্ষার পূর্বশর্ত হলো শিক্ষকদের গুণগত মান বৃদ্ধি করা।

তাই নিঃসন্দেহে এটা বলা যায় যে  শিক্ষকদের গুণগত মান বৃদ্ধি করতে চাইলে তাদের সামাজিক সম্মান ও অর্থনৈতিক সম্মানীর বিষয়টিকেও সমান গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে, নতুবা কোনদিন কাঙ্খিত লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবেনা।

আরো পড়ুন
মানসম্মত বেতন-মর্যাদা না পেলে মেধাবীরা প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশায় আসবেন কেন?
অনলাইনে আপনি যেভাবে জন্ম নিবন্ধন সনদ যাচাই করবেন
২য় শ্রেণির স্নাতক ডিগ্রীধারী শিক্ষকরা ১৩তম নয় বরং ১০ম গ্রেডের যোগ্য

Check Also

প্রাথমিক শিক্ষক

সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড দিয়ে পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হোক

দেশের নীতিনির্ধারকগণ বলেন প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছেন শিক্ষার ভিত্তি, ভিত্তি মজবুত না হলে শিক্ষার উন্নয়ন কখনোই …

প্রাথমিক শিক্ষক

১০ম গ্রেড দিয়ে সহকারী শিক্ষকদের আর্থ-সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা হোক

প্রাথমিক শিক্ষকরা অবুঝ শিশুদের শিক্ষা দেয়ার মত সবচেয়ে কঠিন ও গুরুদায়িত্ব পালন পালন করেন।পরিশ্রমের দিক …

আপনার মতামত জানান