মেধাবীদের প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করা ও ধরে রাখার ব্যর্থতা লজ্জাজনক

শিক্ষা যদি জাতির মেরুদন্ড হয় তাহলে প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে শিক্ষার মেরুদন্ড।আমাদের প্রতিবেশী দেশসমূহ যখন প্রাথমিক শিক্ষকদের আর্থ-সামাজিক মর্যাদাকে উন্নত করে প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করছেন তখন আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষদের অবস্থান বরাবরই অবহেলিত অবস্থায় রয়েছে।

এভাবে প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের অবহেলিত করে রেখে জাতি কি এগিয়ে যাচ্ছে নাকি দিনে দিনে প্রতিবেশী দেশসমূহের তুলনায় পিছিয়ে পড়ছে তা অনুধাবন করতে আমাদের নীতিনির্ধারক মহোদয়গণ কেন এখনো সক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছেন না?

পূর্বে প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক নিয়োগে শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল পুরুষদের স্নাতক ও মহিলাদের এইচএসসি।বর্তমানে নারী ও পুরুষ উভয়ের সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ যোগ্যতা সর্বনিম্ন ২য় শ্রেণির স্নাতক।

তাছাড়া প্রত্যেক শিক্ষককে নিয়োগ পাওয়ার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য ডিপার্টমেন্ট আইইআর এর অধীনে দেড় বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেসন কোর্স সম্পন্ন করতে হয়।

এই ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন কোর্সটি অত্যন্ত মানসম্মত ও লোডের একটা কোর্স।অথচ স্নাতক +ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করার পরেও একজন প্রাথমিক শিক্ষক এখনও ১৪তম গ্রেডে বেতন পাচ্ছেন।

২০২০সালের ৯ফেব্রুয়ারি সরকার শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডের দাবীকে উপেক্ষা করে ১৪তম গ্রেড থেকে ১৩তম গ্রেডে আপগ্রেড করে যা এখনও কার্যকর হয়নি।তাছাড়া এই ১৩তম গ্রেডে আপগ্রেডের ঢোল পিটানো হলেও আসলে এটি শিক্ষকদের সাথে এক প্রকার প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়।

কারণ এই আপগ্রেডেসনের ফলে শিক্ষকদের বেতন বাড়বে সর্বনিম্ন ২০টাকা এবং সর্বোচ্চ ৩৩০ টাকা।এই সামান্য পরিমাণ বেতন বৃদ্ধি কি শিক্ষকদের সাথে প্রহসন নয়?

বাংলাদেশে স্নাতক শিক্ষাগত যোগ্যতার অধিকাংশ পেশাজীবী যেখানে ১০ম গ্রেডে বেতন পাচ্ছেন সেখানে সর্বনিম্ন ২য় শ্রেণির শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ডিপ্লোমা সম্পন্নকারী শিক্ষকদের ১৩তম গ্রেড দিয়ে বেতন বাড়ানোর এত ঢোল পিটানো শিক্ষকদের জন্য অবমাননাকর নয় কি?

শিক্ষকদের মর্যাদা যদিই সত্যিই দেয়া হতো তাহলে শিক্ষকদের যোগ্যতা থাকার পরেও এই নিম্ন গ্রেডে রাখা হতোনা।অন্য পেশাজীবীদের সাথে প্রাথমিক শিক্ষকদের তুলনা করা চলেনা।অন্য পেশাজীবীদের তুলনায় যতক্ষণ পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষকদের নায্য বেতন-পদমর্যাদা দেয়া হবেনা ততক্ষণ পর্যন্ত মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষাও অর্জিত হবেনা এবং দেশ ও জাতিও উন্নত হতে পারবেনা।

এই ১৩তম গ্রেডে কখনো মেধাবীরা প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট হবেনা এবং কর্মরত মেধাবীরাও সুযোগ পেলে এ পেশা ছেড়ে চলে যাবেন,যেসব মেধাবী শিক্ষক বিভিন্ন কারণে কর্মরত থাকবেন তারা চাইলেও হীনমন্যতার কারণে শতভাগ আন্তরিকতার সাথে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে নিজেদের সচেষ্ট রাখতে পারবেন না।

এই আধুনিক যুগেও প্রাথমিক শিক্ষকতার মতো গুরুত্বপূর্ণ পেশায় মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে ও কর্মরত মেধাবীদের ধরে রাখার ব্যর্থতা জাতির জন্য লজ্জাজনক।

অনেক সময় বিভিন্ন গুণী ব্যক্তিরা বলেন প্রাথমিক শিক্ষকরা সংখ্যায় বেশী তাই তাদের উচ্চ বেতন-মর্যাদা দিতে সরকার ভয় পায়।এই ডিজিটাল যুগে এই কথাটা পুরোপুরি হাস্যকর।পৃথিবীর সবগুলো দেশেই প্রাথমিক শিক্ষকদের সংখ্যা বেশী থাকে এবং থাকবেই।

অন্যদেশের তুলনায় আমাদের দেশে বরং প্রাথমিক শিক্ষার্থীর অনুপাতে প্রাথমিক শিক্ষকের সংখ্যা অনেক কম।মালয়েশিয়ার ৬০০শিক্ষার্থী বিশিষ্ট একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংখ্যা ৯৫জন।তাহলে মালয়েশিয়া কীভাবে তাদের প্রাথমিক শিক্ষকদের উচ্চ বেতন-পদমর্যাদা দিয়েছেন?

আচ্ছা এখন হয়তো কেউ বলবেন মালয়েশিয়া উন্নত দেশ তাই দিচ্ছেন।শ্রীলংকাতো আমাদের দেশের চেয়ে উন্নত নয়,তাহলে শ্রীলংকা কীভাবে তাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের ১ম শ্রেণির মর্যাদা দিয়েছেন।

ভারতে কীভাবে মেধাবীরা অন্য পেশা ছেড়ে প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট হচ্ছেন এবং যোগদান করছেন।নেপাল ও পাকিস্তানও কীভাবে প্রাথমিক শিক্ষকদের উচ্চ বেতন-মর্যাদা দিচ্ছেন?

তাদের অর্থনীতিতো আমাদের অর্থনীতির চেয়ে উন্নত নয়।আসলে আমাদের টাকা কোন সমস্যা নয়,সমস্যা হচ্ছে মানসিকতার।প্রাথমিক শিক্ষকদের উচ্চ বেতন-পদমর্যাদা দিতে আমাদের মন সায় দেয়না।

কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষকদের অবহেলিত রাখতে গিয়ে যে পুরো দেশটা দিনে দিনে পিছিয়ে যাচ্ছে সেদিকে কারো নজর নেই।তাইতো ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা যখন তাদের জিডিপির ৪% এর অধিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের পিছনে ব্যয় করেন,সেখানে আমাদের দেশে শিক্ষা ও শিক্ষকদের পিছনে জিডিপির ১.৫% এরও কম ব্যয় করা হয়।

তাইতো দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন ও পদমর্যাদা সর্বনিম্ন।

লেখক-মাহফিজুর রহমান,শিক্ষক ও ব্লগার

আরো পড়ুন
সন্তানকে পাঠাতে নিরাপদ বোধ না করলেও স্কুল খোলার পক্ষে বেশিরভাগ মানুষ
২৪মে থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থগিত হয়ে যাওয়া পরীক্ষা শুরু হবে
যারা স্কুল-কলেজ খুলে দেয়ার উসকানি দিচ্ছেন,তারা দেশ ও জাতির শত্রু-আমু
আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন কার্ড বিতরণ শুরু
আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে জেএসসি পরীক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন কার্ড বিতরণ শুরু

Check Also

প্রাথমিক শিক্ষক

সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড দিয়ে পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হোক

দেশের নীতিনির্ধারকগণ বলেন প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছেন শিক্ষার ভিত্তি, ভিত্তি মজবুত না হলে শিক্ষার উন্নয়ন কখনোই …

প্রাথমিক শিক্ষক

১০ম গ্রেড দিয়ে সহকারী শিক্ষকদের আর্থ-সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা হোক

প্রাথমিক শিক্ষকরা অবুঝ শিশুদের শিক্ষা দেয়ার মত সবচেয়ে কঠিন ও গুরুদায়িত্ব পালন পালন করেন।পরিশ্রমের দিক …

আপনার মতামত জানান