একই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে শিক্ষকেরা ১৩তম গ্রেড আর অন্যরা ১০ম গ্রেড

২.
কর কর্মকর্তা, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা, পুলিশের উপপরিদর্শক থেকে সহকারী পুলিশ সুপার থেকে বিসিএস কৃষি, ইউপি সচিব, ব্যাংক কর্মকর্তা সবাই স্নাতক পাস করেই তবে চাকরির পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। কিন্তু উপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত আইসিএস মডেলে এখানে বিসিএস চালু হয়েছে।

কিন্তু শিক্ষিত জনগণ গড়ে তুলতে যে বনিয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা, সেখানে বিসিএস নেই। ব্রিটিশরা চায়নি তাই স্বাধীন দেশে আমরাও চাই না। অথচ ওপরের সব পেশাতেই প্রাথমিকের মতো স্নাতক পাসই যোগ্যতা। একই যোগ্যতা নিয়ে শিক্ষকেরা ১৩তম গ্রেড আর অন্যরা ৭ম থেকে ১০ম গ্রেডের। অথচ সংবিধানের ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদের ১ ও ২ ধারাতেই সুযোগের সমতার কথা বলা আছে। রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কোথায় সেই কার্যকর ব্যবস্থা?

অন্যান্য চাকরিতে গড়ে দৈনিক টিফিন ভাতা ২০০ টাকা। আর প্রাথমিকের শিক্ষকেরা মাসে পান ২০০ টাকা। পাখির মতো কিচিরমিচির শব্দ-ঝড়ের মধ্যে ৪-৫টি ক্লাস নিয়ে একজন শিক্ষক ৬ টাকার নাশতা খান। এমনকি অর্থমন্ত্রীর ভাষায় ‘ঘুষ হলো স্পিডমানি’, সেই স্পিডমানি প্রাপ্তির সম্ভাবনাটুকুও এখানে নেই।

‘প্রসঙ্গ সাহিত্য’ গ্রন্থে আলাপচারিতায় আন্তন চেকভ শত বছর আগে বলেছিলেন, ‘আমাদের রুশ গ্রামাঞ্চলে ভালো বুদ্ধিমান সুশিক্ষিত শিক্ষকের যে কত প্রয়োজন, সে কথা যদি তুমি জানতে।… শিক্ষককে একজন অভিনেতা, একজন শিল্পী হতে হবে। নিজের কাজকে তার গভীরভাবে ভালোবাসতে হবে।

আর আমাদের শিক্ষকেরা হলো অর্ধশিক্ষিত এবং উদাসীন।… জনগণের শিক্ষার দায়িত্ব আমরা যার ওপর ন্যস্ত করেছি—খেয়াল কর, জনগণের শিক্ষা, তাকে এই রকম তুচ্ছ বেতন দেওয়া এক অসম্ভব ও অবিশ্বাস্য ব্যাপার। …আমাদের সবার কলঙ্ক এটা।’

শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষ অর্জন করে স্বপ্ন আর আত্মমর্যাদা। কিন্তু যিনি এই স্বপ্ন ও মর্যাদা নির্মাণ করবেন, সেই শিক্ষকই যদি দেখেন চারপাশের পেশাজীবীরা তাঁকে সম্মান করছে না, তখন? অথচ সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ২০ (১) অনুচ্ছেদ বলছে, ‘“প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতানুসারে প্রত্যেকে কর্মানুযায়ী”— এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করিবেন।’

তাহলে এই নীতি বাস্তবায়িত হচ্ছে না কেন? কারণ, একই ভাগের ৮ (২) নং অনুচ্ছেদের শেষ বাক্যাংশ ‘তবে এই সকল নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হইবে না।’ মানে রাষ্ট্র যদি এই মূলনীতিগুলো না পালন করে তবে আদালত দ্বারা আদায় করা যাবে না।

কয়েক দিন আগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। পাকিস্তানে প্রথম হরতাল পালনকারী শিক্ষকেরা স্বাধীন বাংলাদেশে দাবি করতে ভুলে গেছেন। শিক্ষকেরা দ্বিতীয় শ্রেণিতেই খুশি। রাষ্ট্র সেটুকুও দিতে নারাজ। তাকে হাইকোর্ট দেখাতে হয়। অথচ ২০১৪-এর নির্বাচনের আগে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল সময়ের ব্যাপার মাত্র। সেই সময় আর আসে না!

৩.
পূর্ব বাংলা কৃষক আর তফসিলি জাতির দেশ। ঢাকার নবাব পরিবার ছাড়া গোটা দেশেই জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক তফাত ছিল না তেমন। সেই দেশটাতে ৫ ভাগ লোকের হাতে ২৭ ভাগ সম্পত্তি চলে গেল। কথা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে সেইটুকু বৈষম্যও কমবে। কিন্তু খোদ রাষ্ট্রই উদ্ভট উটের পিঠ যে!

৪৫ বছর ধরে বেতন স্কেলের ১০টি ধাপ ছিল। সর্বনিম্ন পদের বেতন ১০ টাকা বাড়লে সর্বোচ্চ ধাপের বাড়ত ১০০। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণায় সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে দাবি ছিল ১০ অনুপাত ১-কে ৩ অনুপাত ১-এ নামিয়ে আনা হবে। কিন্তু বছর পাঁচেক আগে ব্যবধান আরও বাড়িয়ে ২২টি ধাপে পরিণত করা হয়। অন্যদিকে পে-কমিশন যতটি হয়েছে, মজুরি কমিশন হয়েছে তারও অর্ধেক। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য কৃষি প্রশ্নের মীমাংসা আর বেতন-মজুরি কাঠামোর ফয়সালা। বাংলাদেশ একটাও করেনি।

লেখকঃ নাহিদ হাসান রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সাবেক সভাপতি। [email protected]

সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো

Check Also

প্রাথমিক শিক্ষক

সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড দিয়ে পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হোক

দেশের নীতিনির্ধারকগণ বলেন প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছেন শিক্ষার ভিত্তি, ভিত্তি মজবুত না হলে শিক্ষার উন্নয়ন কখনোই …

প্রাথমিক শিক্ষক

১০ম গ্রেড দিয়ে সহকারী শিক্ষকদের আর্থ-সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা হোক

প্রাথমিক শিক্ষকরা অবুঝ শিশুদের শিক্ষা দেয়ার মত সবচেয়ে কঠিন ও গুরুদায়িত্ব পালন পালন করেন।পরিশ্রমের দিক …

One comment

  1. হাইকোর্টে রিট করতে হবে তাহলে কিছুটা সমাধান হতে পারে নতুবা এই বাংলাদেশকে কার কথা শুনে কে কার কথা ভাবে

আপনার মতামত জানান