পাঠ্যপুস্তক উৎসব নিয়ে অনিশ্চয়তা,সবচেয়ে বেশি সংকটে প্রাথমিক স্তর

পাঠ্যপুস্তক উৎসব’ এবারে সঠিক সময়ে অনুষ্ঠিত করা সম্ভব হবে কিনা সে বিষয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কোন বইও জেলা ও উপজেলায় পাঠানো সম্ভব হয়ে উঠেনি।

৩টি কারণে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান প্রাথমিকের বইয়ের মুদ্রণ কাজ বন্ধ করে বসে আছে।অন্যদিকে মাধ্যমিকের বইয়ের মুদ্রণ কাজ আটকে গেছে কেবল সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করার কারণে ।আর  এই সংকটজনক অবস্থায় শিক্ষার্থীদের কাছে যথাসময়ে বিনা মূল্যের পাঠ্যবই পৌঁছানো নিয়ে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।আজকে ১৬ অক্টোবর দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা যায়।প্রতিবেদনটি লিখেছেন মুসতাক আহমদ।

মাধ্যমিকের বইয়ের প্রচ্ছদের ২য় ও ৩য় পৃষ্ঠায় এবার স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ এবং ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন স্থিরচিত্র ক্যাপশনসহ যুক্ত করার ব্যাপারে বিলম্বে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরপর সেই স্থিরচিত্র অনুমোদনেও বিলম্ব হওয়ার কারণে মুদ্রাকররা তাদের কাজ বন্ধ রেখেছেন।

এ বিষয়ে এনসিটিবি  চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, এ বছর এখন পর্যন্ত কোনো বই আমরা পাঠাতে না পারলেও,রোববার থেকে প্রাথমিক স্তরের বই পাঠানো শুরু করা হবে।

মাধ্যমিক স্তরের কাজেরও অগ্রগতি দ্রুত হবে। কেউ যদি কাজ বন্ধ রাখে, তাহলে দরপত্রের শর্তানুযায়ী তারই ক্ষতি  হবে কেননা, নির্ধারিত সময়ের পর বই সরবরাহ করলে তাদেরকে আর্থিক শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। করোনা পরিস্থিতি এবং অনলাইন দরপত্রের কারণে গত বছরের চেয়ে দেরিতে কাজ শুরু করতে হয়েছে এবার। তবে মুদ্রাকরদের বুঝিয়ে হলেও ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ ইং তারিখের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করা হবে।

এ বছর ১ম থেকে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত সরকার প্রায় সাড়ে ৩৪ কোটি বই বিতরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন । এর মধ্যে ১০ কোটি ২৫ লাখ ৮২ হাজার ৫৫৫টি প্রাথমিক স্তরের,বাকিগুলো মাধ্যমিক, দাখিল এবং ইবতেদায়ি স্তরের।

অন্যান্য বছরে অক্টোবরেই ৩৫ কোটি বইয়ের অন্তত ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মাঠপর্যায়ে পাঠানোর কাজ শেষ হয়ে থাকে। কিন্তু এ বছর এখনও একটি বইও পাঠানো হয়নি। দরপত্রের শর্তানুযায়ী, প্রাথমিকের বই ছাপতে মুদ্রাকররা ৯৮ দিন আর মাধ্যমিকের জন্য ৬০ দিন পেয়ে থাকেন।

কিন্তু এবার বইয়ের চুক্তি গত ৮ অক্টোবর শেষ হয়েছে। সেই হিসাবে মধ্য-জানুয়ারি পর্যন্ত মুদ্রাকররা বই ছাপার সময় পাবেন। এ সময়ের আগে বই না দিলে জরিমানারও সুযোগ নেই বলে জানা গেছে।

এদিকে বইয়ের মুদ্রণ কাজ শুরুতে বিলম্ব এবং বন্ধ করে রাখার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, করোনা পরিস্থিতিতে এবারে কাগজের দাম অবিশ্বাস্যভাবে কমে গিয়েছিল।

গত বছর খোদ এনসিটিবিই যে কাগজ প্রতি টন ৯০ হাজার টাকার উপরে কিনেছে, এবার তারা সেটা কেনে ৬৫ হাজার টাকা করে। আর খোলা বাজারে এই কাগজের দাম ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নেমেছিল। কিন্তু কাগজের মিলগুলো পরস্পর সংঘবদ্ধ হয়ে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন মুদ্রাকররা। এ কারণে কাগজ কেনায় হঠাৎ ঝামেলায় পড়েছেন মুদ্রাকররা।

তবে সবচেয়ে বড় কারণ  হচ্ছে আরও দুটি। ১ম. কাগজের মানে নতুন আরোপিত ‘বাস্টিং ফ্যাক্টর’ (কাগজের শক্তি বা কতটুকু টান দিলে কাগজটি ছিঁড়ে যায়) যুক্ত করা হয়েছে। এটি হচ্ছে, ৮০ শতাংশ জিএসএম (পুরুত্ব) এবং ৮৫ শতাংশ উজ্জ্বলতার পাশাপাশি বাস্টিং ফ্যাক্টর ১৬ থাকতে হবে।

কিন্তু বাংলাদেশে বেশিরভাগ কাগজ মিলই ১৪ মানের কাগজ উৎপাদন করে। ফলে এই মানের কাগজ দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে । ২য়ত, প্রাথমিকের বইয়ের মুদ্রণ মান তদারকের কাজ পেয়েছেন একটি প্রতিষ্ঠান যার নাম ব্যুরো ভেরিটাস। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা হওয়া সত্ত্বেও রহস্যজনকভাবে এই প্রতিষ্ঠানটি কাজ পেয়েছেন।

২০১৭ সালে প্রাথমিকেরই কাজ করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির পারফরমেন্স গ্যারান্টি বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। এ নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের সাথে তখন সম্পর্কের অবনতিও ঘটে। এ ছাড়া গত ২বছর এই প্রতিষ্ঠানটি মাধ্যমিকের বইয়ের পরিদর্শনের কাজ পেয়েছিল।

নানান অভিযোগে এবার এনসিটিবি প্রতিষ্ঠানটিকে এ স্তরের কাজ না দিলেও ডিপিই রহস্যজনক কারণে প্রাথমিকের কাজ দিয়েছেন।  ওই প্রতিষ্ঠানটি পদে পদে বাধা সৃষ্টি করছেন বলে মুদ্রাকররা অভিযোগ করছেন।

দৈবচয়ন ভিত্তিতে কাগজের মান যাচাইয়ের কথা থাকলেও প্রচলিত রীতি ভেঙে  মান যাচাইয়ের নামে হয়রানি করা হচ্ছে।তাছাড়া  প্রতিষ্ঠানটির সক্ষমতার ঘাটতি থাকায় একসাথে বেশি পরিমাণ কাগজ কিনতে পারছে না মুদ্রাকররা।

অদক্ষ কর্মী নিয়োগের  কারণে স্যাম্পল নেয়ার সময়ই কাগজ নষ্ট করা হচ্ছে। এছাড়া কাগজ পরীক্ষার রিপোর্টের ছাড়পত্র মিলতেও বিলম্ব করা হচ্ছে। এমন নানা অভিযোগ উত্থাপন করে বেশকিছু মুদ্রাকর কাজ বন্ধ রেখেছেন বলে বৃহস্পতিবার রাজধানীর বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।

পরে  এ বিষয়ে এনসিটিবির এক সদস্যের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেছেন, ডিপিই প্রাথমিকের বইয়ের পরিদর্শন প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করেন । সংস্থাটিকে এসব তথ্য জানিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এবারে প্রাথমিকের বই নিয়ে খুবই ঝুঁকি তৈরি হয়েছে তাই সময়মতো বই ওঠানো বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

এ বিষয়েকথা বলতে ব্যুরো ভেরিটাসের কান্ট্রি ম্যানেজার সোহেল আজাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আপনি আমার প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন। আপনার সাথে কোন কথা নেই আমার।

একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী ব্যবস্থাপক মো. আফজাল বলেন, তারা ২য় সর্বোচ্চ দরদাতা হলেও ১ম দরদাতার সাথে তাদের দরে বেশি পার্থক্য ছিল না, যা ২০-২২ লাখ টাকার মত হতে পারে।

১ম সর্বোচ্চ দরদাতা কাজটি পায়নি কারণ তাদের কাগজপত্রের ঘাটতি রয়েছে । আর তাদের প্রতিষ্ঠানের কখনও পারফরমেন্স গ্যারান্টি বাজেয়াপ্ত বা অন্য কোনো শাস্তির মুখোমুখি হওয়ার কথা ঠিক নয়। তারা যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কাগজ পরীক্ষা করছেন ।

এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জনাব  আকরাম-আল-হোসেন বলেন, বইয়ের মুদ্রণ কাজ কতটা এগিয়েছে, তা আমাদেরকে এনসিটিবি বলবে ।পরিদর্শন প্রতিষ্ঠান যদি এ ক্ষেত্রে দায়িত্বে অবহেলা করলে, তারা দরপত্রের শর্তানুযায়ী শাস্তির সম্মুখীন হবেন।

অন্যদিকে মাধ্যমিক স্তরের বইয়ের প্রচ্ছদের ২য় ও ৩য় পৃষ্ঠায়  শিক্ষা মন্ত্রণালয়এবার স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ এবং ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন স্থিরচিত্র ক্যাপশনসহ যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন । এ লক্ষ্যে ৭১টি ছবি বাছাই করা হয়।

কিন্তু সেই স্থিরচিত্রগুলো অনুমোদনেও বিলম্ব হয়। এ ছাড়া এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কমিটির উপরও ছবি বাছাই আর ক্যাপশনের ভাষা নিয়েও মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকরা অসন্তুষ্ট ছিলেন । সব মিলিয়ে অনুমোদন প্রক্রিয়া তাই বিলম্ব হয়।

গত মঙ্গলবার এনসিটিবি মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত অনুমোদনপত্র পেয়েছে। অন্যদিকে কভার অনুমোদন না পাওয়ায় মুদ্রাকররা মুদ্রণ কাজ বন্ধ করে রেখেছিলেন।

এর কারণ সম্পর্কে এক মুদ্রাকর বলেন, পাঠ্যাংশ মুদ্রণের সাথেসাথেই বাঁধাই না করলে কাগজ নষ্ট হয়ে যায়। তাই তারা আগে কভার ছাপেন,পরে পাঠ্যাংশ ছাপিয়েই বাঁধাই করে ফেলা হয়। কভার ছাপতে না পারায় বই ছাপাই আটকে যায়।

Check Also

শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা

বিসিএসের প্রিলি–লিখিতসহ গুরুত্বপূর্ণ ৩০টি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে

‘বিসিএস প্রিলি–লিখিতসহ গুরুত্বপূর্ণ ৩০ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস’ শিরোনামে দেশের অন্যতম বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টি ফোর …

বই খুলে দিচ্ছেন এইচএসসি পরীক্ষা,দুই কেন্দ্র সচিবসহ ৫ জন প্রত্যাহার

বই খুলে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার অভিযোগে চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার পালাখাল রোস্তম আলী ডিগ্রি কলেজের দায়িত্বরত …

আপনার মতামত জানান