বাবা-মায়ের পরে যারা ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের মস্তিষ্কে পরম মমতায় শিক্ষার ভিত্তি স্থাপন করেন তারাই হচ্ছেন প্রাথমিক শিক্ষক।দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে শুধু নাম দস্তখত করা ব্যক্তিসহ অধিকাংশ মানুষ এই প্রাথমিক শিক্ষকদেরই ছাত্র ছিলেন।তারপরও এই প্রাথমিক শিক্ষকদের অহেতুক সমালোচনা করার জন্য কিছু মানুষ সবসময় খাড়া হয়ে থাকে।আমরা জাতি হিসেবে দিন দিন যে কত অধমে পরিণত হচ্ছি তা প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রতি কিছু মানুষের আচরণ দেখলেই অনুমান করা যায়।প্রাথমিক শিক্ষকরা যেন গরীবের বউ সবার ভাবী(গ্রাম্য প্রবাদ) হয়ে গেছে
দুইদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ শ্রদ্ধেয় রোবায়েত ফেরদৌস স্যারের প্রাথমিক শিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষক নিয়ে একটি কলাম প্রকাশিত হয়।স্যার কলামটিতে প্রাথমিক শিক্ষকদের মর্যাদা বর্ণনা করতে উন্নত দেশগুলোর উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন যে উন্নত বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের চেয়ে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বেশী।উনার এই লেখাটি অনলাইনে প্রকাশ হলে কিছু মানুষের( দেখতে মানুষ মনে হলেও আসলে অমানুষ) গায়ে ফোস্কা পড়ে।তারা ফেসবুকের কমেন্ট বক্সে প্রাথমিক শিক্ষকদের পাশাপাশি রুবাইয়ত স্যারকেও কিছু বিদ্রুপাত্বক ও বিশ্রী ভাষায় গালি দিয়ে কমেন্টে করে ।দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষককে যারা এভাবে গালিগালাজ করতে পারেন তারা নিরীহ প্রাথমিক শিক্ষকদের সাথে কী ধরণের আচরণ করতে পারেন তা সহজে অনুমান করা যায়?
ফেসবুকে প্রাথমিক শিক্ষকদের বিদ্রূপ করে যারা মন্তব্য করেন, তাদের প্রতিটি বিদ্রূপাত্বক প্রশ্নের জবাব দেয়ার প্রয়োজন মনে করছি।
বিদ্রূপাত্বক প্রশ্ন- উন্নত দেশে প্রাথমিক শিক্ষকরা মেধাবী ও উচ্চতর ডিগ্রীধারী,আপনারাতো এসএসসি পাশ
উত্তর- প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুরুষ শিক্ষকরা প্রথম থেকেই স্নাতক পাশ,মহিলাদের প্রথমে এসএসসি,পরে এইচএসসি এবং বর্তমানে স্নাতক নির্ধারণ করা হয়েছে।পূর্বে সরকার পিছিয়ে পড়া মহিলাদের এগিয়ে নেয়ার জন্য মহিলা শিক্ষকদের যোগ্যতা এসএসসি নির্ধারণ করেছিল।আর আমরা যারা আজকে মাস্টার্স পাস করে লাফাচ্ছি আমাদের মানুষের মত মানুষ করার জন্য এই এসএসসি পাশ শিক্ষকরাই কিন্তু আমাদেরকে পরম স্নেহ-মমতায় শিক্ষা দিয়েছিলেন।যুগের পরিবর্তনে এখন ঘরে ঘরে অনার্স পাশ কিন্তু তখন মেয়েদের এসএসসি পাশ করাও ছিল কষ্টকর।অনেক সময় এমন ঘটেছে যে এসএসসি পাশ করেছে তাকে দেখার জন্য মানুষ দলে দলে তার বাড়ি আসতো।এখন মাস্টার্স পাশকেও পাবলিক পাত্তা দেয়না।
বিদ্রূপাত্বক প্রশ্ন- আপনাদের এত দেয় তবু পেট ভরেনা?
বিদ্রূপাত্বক প্রশ্ন- আপনারাতো বাংলা রিডিং পড়াতে পারেন না
উত্তর- এটা দুঃখজনক ও লজ্জাজনক যে কিছু নব্যজাতীয়করণকৃত শিক্ষকের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটা হয়েছে।কিন্তু এই শিক্ষকদের দায় সরকারের,আমাদের নয়।সরকার বেসরকারী থেকে তাদেরকে সরকারী করেছে,এখন সেই শিক্ষকরা বাংলা অথবা ইংরেজি না পারলে তার দায় আমরা যারা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষকতা করছি তারা কেন নিব?এর দায় কর্তৃপক্ষের।
বিদ্রূপাত্বক প্রশ্ন- জেনেশুনেইতো এখানে এসেছেন তাহলে আপনারা শুধু শুধু বেতন নিয়ে কেন লেখালেখি করেন?
উত্তর- হ্যা আমরা কেন প্রত্যেক পেশাজীবী জেনে শুনেই তাদের পেশায় জয়েন করে এবং তাদের নায্য মর্যাদার জন্য আন্দোলন করে।প্রাথমিক শিক্ষকরাও তার ব্যতিক্রম নয়।নার্স,এসআই,বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক,উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাসহ সকল পেশাজীবী জেনে শুনেই তাদের পেশায় এসেছিলেন এবং পরে আন্দোলন করে তাদের মর্যাদা আদায় করেছিলেন।অন্য ডিপার্টমেন্ট যেখানে এসএসসির পরে ডিপ্লোমা করে ১০ম গ্রেডে বেতন পাচ্ছেন সেখানে প্রাথমিক শিক্ষকরা স্নাতক +ডিপ্লোমাধী হয়ে কেন তাদের সমান বেতন-মর্যাদা পাবেন না? সে বিষয়ে কথা বলার অধিকার প্রাথমিক শিক্ষকদের অবশ্যই রয়েছে।আমি বিসিএস নন-ক্যাডার থেকে প্রধান শিক্ষক হয়েছি,আমার নিচের সিরিয়ালে থাকা যারা সরকারি হাইস্কুলের শিক্ষক হয়েছেন তারা পান ১০ম গ্রেড আর আমি সিরিয়ালে উপরে থেকেও কেন ১১তম গ্রেড পাবো?এটা নিয়ে কথা বলার অধিকার আমার রয়েছে।প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যারা এখন শিক্ষক হিসেবে আসতেছেন তারা সচেতন,উচ্চশিক্ষিত ও স্মার্ট।আমরা আগের শিক্ষকদের মত নই যে মুখ বুঝে সব অপবাদ সহ্য করবো।
বিদ্রূপাত্বক প্রশ্ন-আপনাদের চেয়ে কিন্টারগার্ডেন কেন এগিয়ে?
উত্তর- আজকে বাংলাদেশে ছোট বড় যত কর্মকর্তা রয়েছেন বা বর্তমানে যোগদান করছেন তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন তারা কি কিন্টারগার্ডেনের শিক্ষার্থী ছিলেন নাকি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন?তাহলেই উত্তর পেয়ে যাবেন।যারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন বা হচ্ছেন তাদের অধিকাংশই সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন।দেশের যত বড় বড় শিক্ষাবিদ রয়েছেন তারা সবাই কিন্টারগার্ডেন শিক্ষার বিরোধী।কিন্টারগার্ডেনে মানসম্মত শিক্ষা দেয়া হলেতো কোন শিক্ষাবিদ কিন্টারগার্ডেনের বিরোধিতা করতেন না।
তাছাড়া কিন্টারগার্ডেন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকবৃন্দ হচ্ছেন সচেতন এবং ধনী।অভিভাবকবৃন্দ তাদের সন্তানদের পিছনে প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যয় করেন।এই ধনী ও সচেতন অভিভাবকবৃন্দের কাছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে গরীব শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয় হিসেবে দেখার একটা প্রবৃত্তি কাজ করে।কিন্টারগার্ডেন স্কুলগুলোতে লক্ষ্য করলে দেখবেন সেখানে অনেক অভিভাবক নিজেই তাদের সন্তানদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া আসা করেন এবং বাসায় সন্তানদের নিজে পড়ানোর পাশাপাশি হাউজ টিউটর রেখে শিক্ষা দেন।
কিন্টারগার্ডেন স্কুলে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের ডায়েরিতে শিক্ষকরা পড়া হলে টিক দেন,পরবর্তী দিনের বাড়ির কাজ দেন এবং পড়া না হলে ডায়েরীতে ক্রস চিহ্ন দেন।অভিভাবক এবং হাউস টিউটর শিক্ষার্থীর সেই ডায়েরী দেখে বাসায় শিক্ষার্থীকে সেই পড়া আয়ত্ত করান।কিন্টারগার্টেন স্কুলের বইগুলো আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষা নীতিমালা অনুসরণ না করে নিজেদের মত করে চালানো হয়।সারা বিশ্বে কোমলমতী শিশুদের যেখানো পড়াশুনার কোন চাপ দেয়া হয়না বরং বেশী বেশী খেলাধুলার মাধ্যমে তাদের বিকশিত করার জন্য চেষ্টা চালানো হয় সেখানে আমাদের দেশে কিন্ডারগার্ডেন স্কুলগুলোতে কঠিন কঠিন সেই বইগুলো পড়াশুনা করিয়ে শিক্ষার্থীদের অসুস্থ প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দেয়া হয়।
পক্ষান্তরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষার্থী পড়াশুনা করেন তাদের অভিভাবক হচ্ছেন চরম অসচেতন ও গরীব।তাদের সন্তানরা কোন ক্লাসে পড়েন এটাও অনেক অভিভাবক জানেন না,খোঁজও নেন না।অনেক শিক্ষার্থী না খেয়েই স্কুলে চলে আসেন।ক্লাসে গিয়ে দেখা যায় অধিকাংশ শিক্ষার্থীর খাতা নেই, কলম নেই।সরকার উপবৃত্তির যে টাকা দেয় সেই টাকা অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের পড়াশুনার উপকরণ কিনে না দিয়ে নিজেদের সাংসারিক কাজে লাগান।শিক্ষার্থীদের প্রায় স্কুলে আসতে না দিয়ে অভিভাবকগণ বাড়ির ও মানুষের বাসায় কাজ করান।শিক্ষক ক্লাসের মাত্র ৪০মিনিট সময়ে যা পড়ান শিক্ষার্থী ও তার অভিভাবক বাসায় গিয়ে সেই পড়া একটুও অনুশীলন করেনা বা অনুশীলন করান না।
বাসায় গিয়ে অনুশীলন না করলে কোন শিক্ষকের ক্ষমতা নেই মাত্র ৩০/৪০মিনিট সময়ে ২০/৩০/৪০জন শিক্ষার্থীকে দক্ষ করে তোলা।কিন্টারগার্ডেন ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মূল পার্থক্যটা এবং সমস্যাটা এখানেই।
বিদ্রূপাত্বক প্রশ্ন-শিক্ষকদের এত খাই খাই স্বভাব কেন?
উত্তর-এই প্রশ্নটি যারা করেন তারা হয়তো মনে করেন যে প্রাথমিক শিক্ষকরা হচ্ছে এলিয়েন,তাদের খেতে হয়না,পরিবারকে খাওয়াতে হয়না,সমাজে মানিয়ে চলতে হয়না।শিক্ষকদের বেতন অন্য পেশাজীবীর তুলনায় নিম্নমানের এরা এটা জেনেও শিক্ষকদের এই কথা বলে।এরা চায় যে শিক্ষকরা সারাজীবন অবহেলিত হয়ে থাকুক।তাদের পরণে থাকুক একটা জরাজীর্ণ পান্জাবী,চোখে একটা মোটা চশমা ও হাতে একটা জরাজীর্ণ ছাতা।শিক্ষকরা এরকম নিম্নমানের জীবন নির্বাহ করলেতো এদের শিক্ষকদের অপমান করার সুবিধা হয়।শিক্ষকরা উচ্চ বেতন পেয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে চলবে এদের তা সহ্য হয়না।তাই এই শ্রেণির মানুষরা এরকম উক্তি করে।
বিদ্রূপাত্বক প্রশ্ন- প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন অনেক বেড়েছে আর কত?
উত্তর-এই কথা যারা বলে তারা হয় মূর্খ নাহয় হিংসুক।এদের প্রশ্ন দেখে মনে হয় বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বেড়েছে আর বাকিরা যে অবস্থায় রয়েছেন সেখানেই রয়েছে।মৎস্য অফিসারের কর্মচারীরা কয়েকদিন আগে একলাফে ১৬তম গ্রেড থেকে ১১তম গ্রেডে এসেছে।অন্য সরকারি কর্মচারীদের এরকম উদাহরণ চাইলে কমপক্ষে ১শত উদাহরণ দিতে পারবো।এইসব প্রশ্নকারী অন্য ডিপার্টমেন্টেরর কর্মচারীদের সাথেতো পারেনা,তখন আসে নিরীহ প্রাথমিক শিক্ষকদের সাথে টক্কর দিতে।