প্রাথমিক শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয়া হোক

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান ও সহকারী শিক্ষকরা ২০১৯ সালের ২৩শে অক্টোবর তাদের বেতন গ্রেড বাড়ানোর দাবীতে ঢাকার দোয়েল চত্বরে বিক্ষোভ করেছিলেন।তাদের বেতন গ্রেড বৃদ্ধির দাবি আমাদের কাছে নায্য ও যৌক্তিক বলে প্রতিয়মান হয়েছে কারণ তাদের দাবী ছিল মর্যাদা ও সম্মান আদায়ের দাবী।

কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাদের দাবী নীতিনির্ধারকগণের কানে পৌছায়নি।পুলিশ শিক্ষকদের উপর হামলা,মারধর করে তাদের সাথে অমানবিক আচরণ করেছে।শিক্ষকরা পরে শহীদ মিনারে বিভোক্ষ করতে চাইলেও পুলিশের ব্যারিকেডের কারণে সেখানেও তারা পৌছাতে পারেনি। ২০১৭সালে সরকার প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের গ্রেড আপগ্রেডের ব্যাপারে সম্মত হয়েছিল। পরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রণালয় প্রধান শিক্ষকদের ১০ম ও সহকারী শিক্ষকদের ১২তম গ্রেডের প্রস্তাব দিয়েছিল।কিন্তু ২০১৮সালের সেপ্টেম্বরে অর্থমন্ত্রণালয়েরর উপসচিব স্বাক্ষরিত চিঠিতে জানানে হয় যে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন গ্রেড উন্নয়নের কোন প্রয়োজন নেই।

এরপরেই প্রাথমিক শিক্ষকরা তাদের নায্য দাবী আদায়ের জন্য সরব হয়ে উঠে।যদিও সরকার দুই বছর আগে থেকে শিক্ষকদের দাবী পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিলেন। প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা আগে ৩য় শ্রেণির কর্মচারী ছিলেন এবং সে অনুযায়ী বেতন পেতেন।

পরে পদটি ২য় শ্রেণীর কর্মকর্তার পদে উন্নীত করা হয়।তবে দুর্ভাগ্যক্রমে তারা এখনো তাদের প্রত্যাশিত ১০ম গ্রেড পাননি। অন্যদিকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকরা ১৪তম গ্রেডে ও প্রশিক্ষণবিহীন সহকারী শিক্ষকরা ১৫তম গ্রেডে বেতন পাচ্ছেন যা একজন সরকারী স্টেনোগ্রাফার পদের সমতুল্য।

যাহোক সর্বশেষ আন্দদোলনে প্রাথমিক শিক্ষকরা প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড ও সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডের দাবী জানিয়েছিল। কিন্তু ৩০শে অক্টোবর ২০১৯ইং তারিখে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে প্রধান শিক্ষকদের ১১তম ও সহকারী শিক্ষকদের ১৩তম গ্রেড দেয়ার সুপারিশ করেছিল।সেইসাথে নিয়োগবিধি সংশোধনীর সুপারিশ করেছিল যেখানে সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের গ্রেড হবে ৯ম এবং প্রধান শিক্ষকদের গ্রেড হবে ১০ম।পরবর্তীতে ৯ফেব্রুয়ারী ২০১৯ইং তারিখে সহকারী শিক্ষকদের ১৩তম গ্রেডের গেজেট জারি করা হয়।

এর আগে জানা গেছে অর্থমন্ত্রণালয় শিক্ষকদের বর্ধিত এই বেতন দেয়ার জন্য বরাদ্দ রেখেছিল।তাহলে সিদ্ধান্তটি কার্যকর করতে সরকার কেন এত সময় নিল এবং জাতি গড়ার কারিগর প্রাথমিক শিক্ষকদের সাথে কেন খারাপ ব্যবহার করলো?

বাংলাদেশে ৬৫,৯০২টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩২৫০০০ সহকারী শিক্ষক ও ৪২০০০ প্রধান শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন।এটি হতাশাজনক যে শিক্ষকদের তাদের সামাজিক অবস্থান,মর্যাদা,এবং আর্থিক সুবিধার ক্ষেত্রে পরিচয় সংকটে ভুগেন।কম্পিউটার অপারেটর বা হিসাবরক্ষকের চেয়ে স্কুল শিক্ষকের বেতন কম এটা কি অবমাননাকর নয়?

একটি জাতীয় পত্রিকায় সাম্প্রতিক কাজের বিজ্ঞাপনে দেখলাম একজন সহকারী শিক্ষকের জন্য ৮হাজার ও একজন কম্পিউটার অপারেটরের জন্য ১০হাজার টাকা অফার দেয়া হয়েছে।এই যদি পরিস্থিতি হয় তাহলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা কীভাবে শিক্ষকতা পেশায় আসবেন।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার মান কম,তারপরও আমরা প্রতি বছরে বিনামূল্যে বই প্রদান ও এটার সম্প্রসারণে সন্তুষ্ট।অথচ পপুলার ফর ক্যাম্পেইন দ্বারা প্রস্তুতকৃত এডুকেশন ওয়াচ রিপোর্ট অনুযায়ী হাইস্কুলের ইংরেজি ও গণিতে ৫৫%শিক্ষক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়।পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করে যখন এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে যে ৭৫%শিক্ষক পদার্থবিজ্ঞানে,৭৮%শিক্ষক রসায়নে এবং ৬৪%শিক্ষক কোনরকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই বিজ্ঞান পড়ান।

প্রতিবেদনে আরো দেখা গেছে হাইস্কুলের বেশীরভাগ শিক্ষক বোর্ডবইয়ের চেয়ে গাইড বইয়ের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল কারণ গাইড বইয়ে তারা সহজে উত্তরগুলিতে এক্সেস করতে পারেন।এভাবে একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকও শিক্ষার্থীদের কোন যত্ন না নিয়েই সেই বিষয়ে পড়ান।কোন শিক্ষক এটা নিয়ে সচেতন নন যে শিক্ষার্থীরা কীভাবে কার্যকরভাবে শিখতে পারবেন এবং সৃজনশীলতার সাথে সমস্যার সমাধান করতে পারবেন।

সরকার বা স্কুল কর্তৃপক্ষ কেউ প্রশিক্ষণ বিষয়ে উৎসাহী নয়।সরকার শুধু দাবী করে তারা সফলতার সাথে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে দুটি পাবলিক পরীক্ষা পিএসসি ও জেএসসি সফলতার সাথে চালু করেছে।শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা এটার প্রচন্ড বিরোধিতা করলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকার এই ২টি পাবলিক পরীক্ষা বন্ধ করেননি।এই দুটি পরীক্ষা শিক্ষকদের কোচিং সেন্টারগুলোতে জড়াতে ও বাণিজ্যিকভাবে কোচিংকে উৎসাহিত করছে।এই বেসরকারী কোচিং বন্ধ করতে হবে।

আর প্রাথমিক শিক্ষাকে একটি শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত না করলে শিশুরা ভবিষ্যতে চ্যালেন্জ মোকাবেলা করতে ও উচ্চ শিক্ষায় পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম হবেনা।সরকার যদি প্রতিযোগিতামূলক বেতনের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের পাঠদানের জন্য মেধাবী প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হন,তাহলে ভবিষ্যত প্রজন্ম কখনোই মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা পাবেন না যা শেষপর্যন্ত টেকসই উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করবে।

প্রাথমিক শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার করার এখনই উপর্যুক্ত সময়।শিশুরা তখনই আত্ববিশ্বাসী হবে যখন তারা উপর্যুক্ত ও মানসম্মত শিক্ষা পাবে যা সমালোচনা,ভাবনা,সমস্যা-সমাধান,টিম-বিল্ডিং,যোগাযোগ,সহনশীলতা,অখন্ডতা ও সহানুভূতি বিকাশে সহায়তা করবে।তাই প্রাথমিক শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয়া হোক।দেশের মোট বাজেটের সর্বনিম্ন ৫%শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য সরকারকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

Writer-Sheikh Nahid Neazy, chair and associate professor, department of English, Stamford University Bangladesh.

Translated From English to Bangla  by www.primaryeduinfo.com

আরো পড়ুন
শিক্ষকদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছেন প্রাথমিক শিক্ষকরা-অধ্যাপক ড.জাফর ইকবাল
উন্নত বিশ্বে প্রাথমিক শিক্ষকের বেতন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের চেয়ে বেশি
ইউএনও অফিসের দারোয়ান-ড্রাইভারও প্রাথমিক শিক্ষকের চেয়ে বেশি বেতন পায়-অধ্যাপক কামরুল হাসান

Check Also

প্রাথমিক শিক্ষক

সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড দিয়ে পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হোক

দেশের নীতিনির্ধারকগণ বলেন প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছেন শিক্ষার ভিত্তি, ভিত্তি মজবুত না হলে শিক্ষার উন্নয়ন কখনোই …

প্রাথমিক শিক্ষক

১০ম গ্রেড দিয়ে সহকারী শিক্ষকদের আর্থ-সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা হোক

প্রাথমিক শিক্ষকরা অবুঝ শিশুদের শিক্ষা দেয়ার মত সবচেয়ে কঠিন ও গুরুদায়িত্ব পালন পালন করেন।পরিশ্রমের দিক …

আপনার মতামত জানান