সমন্বিত নিয়োগ বিধিমালা ও প্রাথমিক শিক্ষকদের ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া

ফরাসি দার্শনিক রুশো বলেছেন, শিক্ষা হলো শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত আত্মবিকাশ। শিশুদের সামর্থ্য ও শক্তির স্বাভাবিক ও সুষম বিকাশই শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য। শিশুদের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যগুলো আবিষ্কার এবং তা পরিপূর্ণভাবে বিকশিত  করতে শিক্ষা পদ্ধতির বিষয়টি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনিভাবে একটি শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ শিশুর বাহ্যিক আচরণ, চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গির স্থায়ী পরিবর্তনে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। আজকে ১৭ অক্টোবর ২০২০ ইং তারিখ রোজ শনিবার দৈনিক বণিকবার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত অভিমত কলাম থেকে এসব তথ্য জানা যায়।

কখনো কখনো প্রচলিত ধারার শিক্ষা পদ্ধতির কঠোর অনুশাসন, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিকূল পরিবেশ শিশুর শিক্ষাজীবনকে বিপন্ন করতে পারে। তাই শিশুদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশের ক্ষেত্রে একটি গঠনমূলক, আনন্দঘন ও শিশুবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। এটি শিশুদের কৌতুহলী ও আজীবন শিক্ষানবিশ হিসেবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করবে। এই পরিবেশ যেমন নিজ বাসায়, তেমনি বিদ্যালয়ে নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক এই ২টি বিষয়ই অত্যন্ত প্রশংসনীয়, কিন্তু আমরা সরকারি হোক বা বেসরকারি পর্যায়ে হোক, শিশুদের জন্য তাদের প্রতিভা বিকাশের অনুকূল পরিবেশ এখনো সৃষ্টি করতে পারিনি। বেসরকারি পর্যায়ে কেউ কেউ হয়তো কিছুটা করেছেন, কিন্তু তা একেবারে বিচ্ছিন্ন। তবে এক্ষেত্রে ব্র্যাক অনেকটাই এগিয়ে গেছে।

প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সরকারের তরফে সময়ে সময়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। যেমন ২৬ বছর পর প্রাথমিক শিক্ষক পদে পদোন্নতির বন্ধ দুয়ার খুলছে। ৮০% প্রধান শিক্ষক সহকারী থানা শিক্ষা কর্মকর্তা হওয়ার সুযোগ পাবেন। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক থেকে পরবর্তী উচ্চতর পদে পদোন্নতির বন্ধ দুয়ার যেন খুলতে বসছে। ১৯৯৪ সালে পদোন্নতির এই সিঁড়ি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে সারা দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকরা দুটো শর্ত পূরণ করে বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে ‘উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা’ পদে পরীক্ষা দিতে পারেন।

শর্ত দুটো হচ্ছে শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতকোত্তর এবং বয়স ৪৫ বছরের মধ্যে হতে হবে। এভাবে অতীতে অনেক শিক্ষকই কর্মকর্তা হওয়ার সুযোগ পেতেন। ১৯৮৫ সালের নিয়োগ বিধি অনুযায়ী সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক, পরবর্তী পদোন্নতি পেয়ে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা হওয়ার সুযোগ ছিল। ১৯৯৪ সালে নিয়োগ বিধি সংশোধনের পর শিক্ষকদের এভাবে কর্মকর্তা হওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়।

তাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ক্যাডার ও নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের জন্য সমন্বিত নিয়োগ বিধিমালা ২০২০-এর খসড়া প্রকাশ করেছে। খসড়া নিয়োগ বিধিতে বলা হয়েছে, সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার ২ হাজার ৫৮৯টি পদে সরাসরি নিয়োগ হবে। নিয়োগে ৮০ শতাংশ পদ বিভাগীয় প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে এবং বাকি ২০ শতাংশ পদ উন্মুক্ত প্রার্থীদের মধ্য থেকে পূরণযোগ্য। বিভাগীয় প্রার্থী বলতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বোঝানো হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনে কর্মকর্তাদের আরেকটি পদ ইনস্ট্রাক্টর। উপজেলা/থানা/বিসোর্স সেন্টারের ইনস্ট্রাক্টরের ৫০৫টি পদে নিয়োগে মোট পদের ৩৫ শতাংশ পদোন্নতির মাধ্যমে এবং ৬৫ শতাংশ পদ সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করার কথা বলা হয়েছে নতুন নিয়োগ বিধির খসড়ায়।

তবে পদোন্নতিযোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করা হবে। পদোন্নতির জন্য উপজেলা/থানা/রিসোর্স সেন্টারের সহকারী ইনস্ট্রাক্টর/পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষক পদে ন্যূনতম সাত বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা ২য় শ্রেণীর বিএডসহ দ্বিতীয় শ্রেণীর স্নাতক ডিগ্রি থাকতে হবে। সরাসরি নিয়োগের বয়স ৩০ বছর, তবে বিভাগীয় প্রার্থীদের বয়সের কোনো উল্লেখ নেই। এই বিধি বাস্তবায়ন হলে সহকারী শিক্ষকরা আর কখনো অফিসার পদে বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে আবেদন করতে পারবেন না।

তাই তারা এ নিয়োগ বিধি নিয়ে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ইউআরসির সহকারী ইনস্ট্রাক্টরের ৫০৫টি পদে নিয়োগও একই নিয়মে হবে। তবে এখানেও বিভাগীয় প্রার্থী বলতে শুধু প্রধান শিক্ষকদের বোঝানো হয়েছে। দেশের ৬৭টি পিটিআইয়ে ইনস্ট্রাক্টর সাধারণ ও বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক ইনস্ট্রাক্টর পদেও প্রাথমিক শিক্ষকদের বিভাগীয় পদোন্নতির বিধান রাখা হয়নি।

খসড়ার বিষয়ে সহকারী শিক্ষকরা বলছেন, এতদিন উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা পদে পরীক্ষার সুযোগ দেয়া হলেও  পিটিআই ইনস্ট্রাক্টর ও সহকারী ইনস্ট্রাক্টর পদে তাদের বিভাগীয় পরীক্ষার কোন সুযোগ দেয়া হতোনা। নতুন সমন্বিত বিধিমালায় সকল ধরনের কর্মকর্তার পদে থেকে সহকারী শিক্ষকদের বঞ্চিত করা হল। অন্যদিকে উপজেলা-থানা রিসোর্স সেন্টারের ইনস্ট্রাক্টরের ৫০৫টি পদ নিয়োগের ক্ষেত্রে মোট পদের ৩৫ শতাংশ পদোন্নতির মাধ্যমে এবং ৬৫ শতাংশ পদ সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করা হবে।

পদোন্নতিযোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করা হবে। পদোন্নতির জন্য উপজেলা-থানা রিসোর্স সেন্টারের সহকারী ইনস্ট্রাকটার/প্রশিক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষক পদে ন্যূনতম সাত বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা দ্বিতীয় শ্রেণীর বিএডসহ দ্বিতীয় শ্রেণীর স্নাতকোত্তর চাওয়া হয়েছে। সরাসরি নিয়োগের বয়স ৩০ বছর, তবে বিভাগীয় প্রার্থীদের ক্ষেত্রে নিয়োগের বয়সের কোনো সীমা উল্লেখ করা হয়নি। সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক এবং পরবর্তী সময়ে পদোন্নতি দিয়ে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা হওয়ার সুযোগ তৈরি করার দাবি জানিয়েছেন শিক্ষকরা।

আগের নিয়োগ বিধিতে কর্মকর্তা হওয়ার সুযোগ থাকলেও বর্তমানে তা বাতিল করায় অধিকাংশ সহকারী শিক্ষক একই পদে থেকে অবসর গ্রহণ করবেন। চাকরিজীবনে তারা কোনো পদোন্নতি পাবেন না। সম্প্রতি সহকারী শিক্ষক থেকে শতভাগ প্রধান নিয়োগে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী সব পদে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করলে শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা কেটে যাবে।

সবাই নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণে চেষ্টা করবেন। অন্য একজন শিক্ষক নেতা বলেন, আগে প্রধান শিক্ষকদের সব পদে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও নিয়োগ বিধি সংশোধন করায় সেই পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। ফলে একই পদে থেকে চাকরিজীবন শেষ করতে হবে। প্রধান শিক্ষকদের পদোন্নতির জন্য ৪৫ বছর জুড়ে দেয়ায় থানা শিক্ষা কর্মকর্তা হওয়ার পর তাদের অবসরে যেতে হবে। এটি খুব দুঃখজনক।

‘সহকারী শিক্ষক থেকে শতভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক, একইভাবে প্রধান শিক্ষকের পরবর্তী পদগুলোয় শতভাগ পদোন্নতির দাবি জানিয়েছেন শিক্ষক নেতারা। এর বাইরে শিক্ষকদের মধ্যে থেকে বিভাগীয় পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি দিতে হবে। বাইরে থেকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হলে তারা এখানকার কাজকর্ম সঠিকভাবে বুঝবেন না বলে নেতারা দাবি করেন। ফলে তাদের সঙ্গে কাজ করাটা জটিল হয়ে পড়বে।

২০০৩ সালের সরকারি গেজেটেড সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা পদে বিভাগীয় প্রার্থী বলতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকদের কথা বলা হয়েছে এবং উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা পদে বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের বোঝানো হয়েছে। সব শেষ নিয়োগ এভাবেই হয়েছে। প্রস্তাবিত নতুন সমন্বিত নিয়োগ বিধিতে প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের বিভাগীয় প্রার্থী হওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি।

ফলে এ বিধি বাস্তবায়ন হলে সহকারী শিক্ষকরা আর কখনো অফিসার পদে বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে আবেদন করতে পারবেন না। প্রাথমিক শিক্ষক নেতাদের দাবি, তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি সহকারী শিক্ষক মাস্টার্স পাস। অনেকে বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। কিন্তু এ নিয়োগ বিধির কারণে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহ দেখাবেন না।

নতুন নিয়োগ বিধিতে পিটিআই ইনস্ট্রাক্টর ইউআরসি ইনস্ট্রাক্টর ও সহকারী ইনস্ট্রাক্টর পদে বিএড ডিগ্রির কথা বলা হয়েছে। অথচ প্রাথমিক শিক্ষকদের বিএড করার সুযোগ খুব একটা নেই। বিএড করার সুযোগ না দিয়ে নিয়োগ পরীক্ষায় এই যোগ্যতা চাওয়ার বিষয়টি তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি।

 আন্তর্জাতিক গবেষণা অনুযায়ী বেড়ে ওঠার বয়সে যেসব শিশু খেলার ছলে শিক্ষালাভ করে, তারা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় সব বিষয়েই ভালো দক্ষতা প্রদর্শন করে। খেলার মাধ্যমে শিক্ষা বা শিক্ষার মাধ্যমে খেলা একটি শিশুকে কৌতূহলী, সৃজনশীল এবং তার বুদ্ধিমত্তার সঠিক বিকাশ ঘটাতে অনুপ্রেরণা জোগায়, তাই রাষ্ট্রকে পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে শিশুরা আনন্দঘন পরিবেশে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।

আর যারা এই শিক্ষা প্রদান করবেন, তাদের সঠিকভাবে নির্বাচন করা, নির্বাচনের পরে সঠিক প্রশিক্ষণ প্রদান করাও রাষ্ট্রের পবিত্রতম দায়িত্ব। সঙ্গে সঙ্গে যারা এই দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন, তাদেরও জাতি গঠনের লক্ষ্যে শিশুদের শিক্ষাদানকে একটি ব্রত হিসেবে নিতে হবে।

তবে তারা যাতে সামনের দিকে এগোতে পারেন সেই ব্যবস্থা রাষ্ট্রকে করতেই হবে। তা না হলে শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষায় যাদের প্রয়োজন, তারা এখানে আসবেন না। সেটি আমরা নিশ্চয়ই চাইব না।

লেখক-মাছুম বিল্লাহ: ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত, প্রেসিডেন্ট ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশেন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)

আরো পড়ুন
বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবীদের প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া উচিত-অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক
মানসম্মত বেতন-মর্যাদা না পেলে মেধাবীরা প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশায় আসবেন কেন?
অনলাইনে আপনি যেভাবে জন্ম নিবন্ধন সনদ যাচাই করবেন

Check Also

প্রাথমিক শিক্ষক

সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড দিয়ে পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হোক

দেশের নীতিনির্ধারকগণ বলেন প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছেন শিক্ষার ভিত্তি, ভিত্তি মজবুত না হলে শিক্ষার উন্নয়ন কখনোই …

প্রাথমিক শিক্ষক

১০ম গ্রেড দিয়ে সহকারী শিক্ষকদের আর্থ-সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা হোক

প্রাথমিক শিক্ষকরা অবুঝ শিশুদের শিক্ষা দেয়ার মত সবচেয়ে কঠিন ও গুরুদায়িত্ব পালন পালন করেন।পরিশ্রমের দিক …

আপনার মতামত জানান