এইচএসসি পাশ সহকারী শিক্ষকরা ১৩ তম গ্রেড পাবেন কি?

শিক্ষকদের নিয়োগকালীন শিক্ষাগত যোগ্যতা দু’রকম থাকায় সবাই এই স্কেলে বেতন পাবেন কিনা, তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সংশয়। ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত দিতে শুরু করেছেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা। কোনো কোনো উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মনে করছেন, যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক (স্নাতকের নিচে), তারা ১৩তম গ্রেডে বেতন পাওয়ার যোগ্য নন।

আবার কোনো কোনো উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মনে করছেন, সরকারি প্রজ্ঞাপনে যেহেতু সুনির্দিষ্টভাবে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিচারে কে পাবেন আর কে পাবেন না- তা নির্ধারণ করে দেওয়া নেই, সংগত কারণে সব সহকারী শিক্ষকই বর্ধিত বেতনের সুবিধা পাবেন।

এ বিষয়ে আলাপকালে কয়েকজন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সমকালকে জানান, এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে স্পষ্টীকরণ পত্র জারি করা দরকার। নতুবা এই বিভ্রান্তি থেকেই যাবে।

জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আকরাম আল হোসেন বলেন, শিক্ষকরা সবাই যাতে সুবিধা পান, তা নিয়ে আমরা কাজ করছি।

তবে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে, শিক্ষকরা সবাই বর্ধিত বেতনের সুবিধা পাবেন না। কারণ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের স্বীকৃত প্রাথমিক শিক্ষকদের সর্বশেষ নিয়োগবিধি-২০১৯ অনুযায়ী, সহকারী শিক্ষকদের যোগ্যতা কমপক্ষে দ্বিতীয় শ্রেণির স্নাতক ডিগ্রি থাকতে হবে। এ নিয়োগবিধি অনুসারে এর চেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকদের ১৩তম গ্রেডে বেতন দেওয়ার সুযোগ নেই। বর্তমানে সারাদেশে ৬৫ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে তিন লাখ ৫২ হাজার সহকারী শিক্ষক কর্মরত। তাদের ৬০ শতাংশই নারী।

আগের নিয়োগবিধিতে নারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক ও পুরুষদের জন্য স্নাতক নির্ধারণ করা ছিল। এ কারণে ১৩তম গ্রেডে বেতন পাওয়ার যোগ্যতা কমপক্ষে স্নাতক দ্বিতীয় শ্রেণি নির্ধারণ করা হলে সহকারী শিক্ষকদের বড় অংশই ১৩তম গ্রেড প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবেন। যাদের মধ্যে অধিকাংশ নারী শিক্ষক।

জাতীয় বেতন স্কেলের ১১তম গ্রেডে বেতনের দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন করার পর গত ৯ ফেব্রুয়ারি এই শিক্ষকদের ১৩তম গ্রেডে বেতন দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। ১৩তম গ্রেডের প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে এই গ্রেডের সুবিধাপ্রাপ্তি নিয়ে নানা জটিলতা দেখা দেয়।

কারণ, চিরায়ত নিয়মে বেতন নিম্নধাপে নির্ধারণ করলে শিক্ষকদের বেতন বর্তমানের চেয়েও কমে যাচ্ছিল। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিবের হস্তক্ষেপে ১৩তম গ্রেডের উচ্চধাপে বেতন নির্ধারণ করায় সে জটিলতার সমাধান হয়। কিন্তু এবার সব সহকারী শিক্ষকের এই সুবিধা দেওয়া নিয়ে নতুন করে অস্পষ্টতার সৃষ্টি হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ১৩তম গ্রেডের উচ্চধাপে প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের বেতন নির্ধারণের নির্দেশনা-সংক্রান্ত চিঠি জারির পর গত ১৩ আগস্ট কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হিসাবরক্ষণ অফিসের ফেসবুক পেজে শুধু স্নাতক দ্বিতীয় শ্রেণি বা স্নাতকোত্তর পাস শিক্ষকদের সনদ ও অন্যান্য কাগজপত্র নিয়ে কার্যালয়ে যোগাযোগ করার জন্য শিক্ষকদের নির্দেশ দিয়ে একটি পোস্ট দেওয়া হয়।

১৬ আগস্ট খুলনার দীঘলিয়া উপজেলা শিক্ষা অফিসের ফেসবুক পেজেও আরেকটি পোস্ট দেওয়া হয়। সেখানেও বলা হয়, শুধু স্নাতক দ্বিতীয় শ্রেণি পাওয়া সহকারী শিক্ষকরাই ১৩তম গ্রেডের সুবিধা পাবেন। একই সময়ে ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তা আবুল বাসার মো. বাহাউদ্দীন নিজ স্বাক্ষরে একটি অফিস আদেশ জারি করেন।

তাতেও লেখা হয়, সরকার ঘোষিত ১৩তম গ্রেডের প্রজ্ঞাপনের শর্তের ‘ক’ ধারায় শিক্ষক নিয়োগবিধিমালা ২০১৯-এর তফসিল (বিধি-২ গ) অনুযায়ী দ্বিতীয় শ্রেণির স্নাতক (সম্মান) বা সমমানের ডিগ্রি থাকা প্রযোজ্য। চরভদ্রাসন শিক্ষা অফিসের আদেশটি ফেসবুকে আসার পর প্রাথমিক শিক্ষকদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো নির্দেশনা না থাকার পরও এমন অফিস আদেশ জারি করায় শিক্ষকদের অনেকে একে ‘দায়িত্বহীন অফিস আদেশ’ বলেও সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় তোলেন। শিক্ষকদের প্রতিবাদের মুখে দীঘলিয়া উপজেলা শিক্ষা অফিস তাদের ফেসবুক পেজ থেকে পোস্টটি সরিয়ে নেয় এবং চরভদ্রাসন শিক্ষা অফিস আগের আদেশ বাতিল করে নতুন আরেকটি আদেশ জারি করে।

এ নিয়ে জানতে চাইলে চরভদ্রাসন উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তা আবুল বাসার মো. বাহাউদ্দীন বলেন, ‘সবাই এই গ্রেডে বেতন পাবেন কিনা, এখনও স্পষ্ট নয়। স্পষ্টীকরণ কোনো চিঠি আমরা পাইনি।’ আর দীঘলিয়া উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শাহনাজ পারভীন বলেন, ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বিষয়টির ব্যাখ্যা না পাওয়ায় এই অস্পষ্টতা দূর করা যাচ্ছে না।

আমি হিসাব অফিসে যোগাযোগ করে জেনেছি, তারা এখনও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আদেশের এনডোর্স কপি পাননি। পেলে বোঝা যেত কী করা হবে।

এ বিষয়ে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘সহকারী শিক্ষকদের ১৩তম গ্রেড পাওয়া নিয়ে চরভদ্রাসন উপজেলা শিক্ষা অফিসের আদেশ ও দীঘলিয়া শিক্ষা অফিসের ফেসবুক পোস্টের বিষয়ে শিক্ষকরা আমাকে জানান।

আমি ওই দুই উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং কেন্দ্রীয় হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে নির্দেশনা আসা পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতে বলি। কারণ, প্রজ্ঞাপনে শর্ত থাকলেও নিয়োগবিধিতে শর্তের রহিতকরণ ও আগের নিয়োগবিধির হেফাজতের কথা বলা হয়েছে। আমার ওই দুই সহকর্মী বিষয়টি বুঝতে পেরে তাদের নিজ নিজ অফিস আদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।’

জয়পুরহাট জেলার হিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান চঞ্চল বলেন, অফিস আদেশগুলো নিয়ে ফেসবুকে বিতর্ক দেখা দেওয়ার পর আমি নিজেও শিক্ষা কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। অফিস আদেশগুলো তারা প্রত্যাহার করে নেওয়ায় আমরা সন্তুষ্ট।

বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ বলেন, প্রজ্ঞাপনে ২০১৯ সালের নিয়োগবিধির তফসিলের (২-এর গ) কথা উল্লেখ আছে।

কিন্তু নিয়োগবিধি ২০১৯-এর ১০-এর ১ ও ২-এর রহিতকরণ ও হেফাজতকরণ কলামে উল্লেখ আছে, ‘২০১৩ নিয়োগবিধি রহিতকরণ সত্ত্বেও উক্ত বিধিমালার অধীন যে সকল কার্যক্রম নিষ্পন্ন হয়েছে, তা এই বিধিমালার (২০১৯) অধীন সম্পন্ন হয়েছে বলে গণ্য হবে এবং এই বিধিমালা জারির তারিখে অনিষ্পন্ন সকল কার্যাদি যতদূর সম্ভব এই বিধিমালার অধীন নিষ্পন্ন করতে হবে।

তাই এই বিধিমালা অনুসারে সারাদেশের সব সহকারী শিক্ষকই ১৩তম গ্রেডের সুবিধা পাবেন। এই শিক্ষক নেতা বলেন, ২০১৪ সালের উন্নীত স্কেলের প্রজ্ঞাপনেও এমন শর্ত ছিল।

কিন্তু তখনও কোনো সহকারী শিক্ষক উন্নীত স্কেল থেকে বঞ্চিত হননি। আমরা চাই, এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় হিসাবরক্ষণ অফিসের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা, যাতে সব শিক্ষকের ১৩তম গ্রেডে বেতনপ্রাপ্তি নিশ্চিত হয়।

Check Also

শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা

বিসিএসের প্রিলি–লিখিতসহ গুরুত্বপূর্ণ ৩০টি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে

‘বিসিএস প্রিলি–লিখিতসহ গুরুত্বপূর্ণ ৩০ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস’ শিরোনামে দেশের অন্যতম বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টি ফোর …

বই খুলে দিচ্ছেন এইচএসসি পরীক্ষা,দুই কেন্দ্র সচিবসহ ৫ জন প্রত্যাহার

বই খুলে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার অভিযোগে চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার পালাখাল রোস্তম আলী ডিগ্রি কলেজের দায়িত্বরত …

আপনার মতামত জানান